করোনা মোকাবেলায় একাট্টা দেশের তরুণেরা
- মো. আল-আমিন মাসুদ
- প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২০, ০২:১৯ PM , আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২০, ০৩:০৮ PM
হে তারুণ্য, জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ/ অমৃতের স্পর্শ চায়; অন্ধকারময় ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি/ উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ-শিখা/ জ্বালাময় আত্মার আকাশে, র্ধ্বমুখী আপনারে দগ্ধ করে প্রচণ্ড বিস্ময়ে—
এভাবেই তারুণ্য ও তারুণ্যের দীপ্তিকে প্রকাশ করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। ঠিক তার কবিতার মত করেই দেশের দুর্যোগে আবারও এগিয়ে এসেছেন সুকান্ত কিংবা নজরুলের সেই বাঁধনহারা তারুণ্য। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারিতে যখন পুরো বিশ্ব প্রকম্পিত। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি অলিগলি যখন অজানা আতংকে সুনসান নীরব। তখন খেটে খাওয়া দিনমজুরদের দুমুঠো খাদ্য যোগান কিংবা জনসাধারণকে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়া। সব কিছুই বিনে পয়সায় করছে সারা দেশের অগণিত তরুণ-তরুণী। কখনো দলবেঁধে আবার কখনো একাই নিজ উদ্যোগে করছে স্বেচ্ছামূলক এই কাজগুলো। তারুণ্যের সেই দ্বীপ্তিমান কাজগুলোর কিছু অংশ তুলে ধরছেন মো. আল-আমিন মাসুদ
শ্রমজীবী মানুষের পাশে ডাকসু সদস্য সৈকত: করোনা ভাইরাসে দেশজুড়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে গিয়ে শহর যখন ফাঁকা। তখন শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। নিজ উদ্যোগে প্রতিদিনই শ্রমজীবী মানুষকে খাদ্য সহযোগীতা করে যাচ্ছেন তিনি।
ডাকসু নেতা জানান, করোনা মহামারি যতদিন থাকবে ততদিন মানুষের পাশে থাকতে চাই। দেশের এই ক্রান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং একজন ছাত্রনেতা হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমি কর্তব্য মনে করছি। মহামারিতে তাদের অবস্থা ভয়াবহ হতে পারে সে অনুভূতি থেকে তাদের পাশে দাঁড়ানো।
হোম কোয়ারেন্টাইন থাকা মানুষের পাশে সাইবার ৭১: করোনায় সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ। সরকাররের পক্ষ থেকে যখন সবাইকে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে বলা হচ্ছে। তখন বাড়িতে অলস সময় কাটানো মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘সাইবার ৭১’ নামে বাংলাদেশি ইথিক্যাল হ্যাকিং গ্রুপ।
ফেসবুকে আলাদা গ্রুপ খুলে প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে বিনামূল্যে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে শেখাচ্ছে তারা। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়ার শর্তে এবং অবসর সময়গুলো উপভোগ যোগ্য করার জন্য ইথিক্যাল হ্যাকিং প্রিমিয়াম কোর্সের গুরুত্বপূর্ণ কিছু টপিক নিয়ে ফ্রিতেই অনলাইন কোর্স পরিচালনা করছেন তারা।
বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিলো বাঁধন তিতুমীর কলেজ ইউনিট: বাঁধনের সকল ইউনিটের ন্যায়ে সরকারি তিতুমীর কলেজ ইউনিটের বাঁধন কর্মীরাও এগিয়ে এসেছেন করোনা মোকাবেলায়। এরই মধ্যে তারা নিজ উদ্যোগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণ করেছেন তারা। এ সম্পর্কে বাঁধন, তিতুমীর কলেজ ইউনিটের সহ সভাপতি আফরোজা আক্তার তন্বী জানান, গত রবিবার (২২ মার্চ) বেলা ১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বাঁধন অফিসে ৫০ মিলি বোতলের ১৮০টি হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করে বাঁধন কর্মীরা।
পরে বিকেলে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী, কলেজের কর্মচারী, দিনমজুর, রিকশাচালক, ড্রাইভার, গার্ড সহ দরিদ্র জনগণের মাঝে বিতরন করা হয়েছে। একই সাথে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কি কি করণীয় সে ব্যাপারেও সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হয়েছে। এছাড়াও করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্যাম্পাস ও এর আশ পাশের এলাকায় লিফলেট লাগিয়ে প্রচারণাও করি আমরা।
সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করলো চাঁদপুর জেলার মূলপাড়া গ্রামের যুবসমাজ: গ্রামের অসহায় মানুষদের করোনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা সহ নানা বিষয় সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার মূলপাড়া গ্রামের যুবসমাজ। এই উদ্যোগের অন্যতম উদ্যোক্তা এম কে হাসান সবুজ জানান, ঢাকা থেকে গ্রামে এসে দেখি অবস্থা অনেক নাজুক।
গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো করোনা সম্পর্কে অবগত না থাকায় সচেতনও ছিলো না। তাই গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা করোনা সচেতনতা মূলক লিফলেট বিতরণ করেছি। সবাইকে করোনা কিভাবে ছড়ায় এবং এর প্রতিরোধে কি কি করণীয় তা বুঝিয়েছি। লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি গ্রামের মসজিদের অজুখানায় সাবানের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়াও আমরা দরিদ্র মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি সকলে সহযোগিতায় খুব শীঘ্রই তা করতে পারবো।
করোনায় ঘরবন্দি অসহায় মানুষদের সাহায্যের পরিকল্পনা করছে পারডব: এক ঝাঁক উদ্যোমী তরুণদের সংগঠন ‘পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অফ বাংলাদেশ-পারডব’। করোনা মোকাবেলায় তারা ইতোমধ্যে সচেতনতামূলক অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
তাদের ভবিষ্য পরিকল্পনা সম্পর্কে সংগঠনটির সভাপতি আকাশ ঘোষ প্রিন্স জানান, করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ দিনদিন ভয়ংকর পরিণতি লাভ করছে। ইতোমধ্যে স্থবির হয়ে গিয়েছে অধিকাংশ এলাকা। হত দরিদ্র, পথশিশু, বাস্তুহারা, নিম্নবিত্তরা গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে দিনে আনে দিন খায় মানুষগুলো হয়ে পড়েছে অসহায়। না খেয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। তাই আমরা চাচ্ছি, এই মানুষগুলোকে সাহায্য করতে। আমরা পরিকল্পনা করছি অসহায় মানুষদের চাল, আলু, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে সাহায্য করার। আর এর জন্য ইতোমধ্যে ফান্ড সংগ্রহ ও পরিকল্পনা চলছে। আসুন আমরা চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত খাবার বাসায় মজুদ না করি এবং অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াই।
মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান করছে বিবেক ফাউন্ডেশন: সারাদেশের বিভিন্ন তরুণতুর্কিদের নিয়ে সমাজ সেবামূলক কাজ করে বিবেক ফাউন্ডেশন। তারই ধারাবাহিকতায় করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ইতোমধ্যে সারাদেশে বিবেক ফাউন্ডেশনের কর্মীরা সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা মূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এছাড়াও পরিকল্পনা করছে নিম্ন আয়ের মানুষদের সহযোগিতা করার।
এ সম্পর্কে বিবেক ফাউন্ডেশনের সভাপতি এম এ মনোয়ার বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশ। পুরো দেশের মানুষই যেনো আজ অবরুদ্ধ। দেশের এমন জরুরি পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ক্ষুধার জ্বালায় মরে যাওয়ার উপক্রম। অসহায় এই মানুষগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরের রিক্সা চালকদের অবস্থাও একেবারে করুণ! প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে ঢাকায় রিক্সা চালিয়ে কোন রকমে জীবিকানির্বাহ করে তারা! মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে দেশের এই ক্রান্তিকালে অসহায় রিক্সা চালকদের মাঝে বিবেক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আমরা জরুরি ত্রাণ বিতরণ করার পরিকল্পনা করেছি। স্বল্প পরিমাণে হলেও তাদের হাতে আমরা একটি প্যাকেজ তুলে দিতে চাচ্ছি। যার মধ্যে থাকবে চাল, ডাল, আলু, লবন, সাবানসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। আমাদের এই উদ্যোগকে সফল করতে আপনাদের সকলের একান্ত সহযোগিতাও প্রয়োজন।
করোনা মোকাবেলায় সাধারণ মানুষের পাশে গান্না ইউনিয়ন বিচিত্রা: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘গান্না ইউনিয়ন বিচিত্রা’ করোনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের মধ্যে সচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে গ্রহণ করা হয়েছে নানা উদ্যোগ।
এ সম্পর্কে মামুন সোহাগ বলেন, সারা বছরই আমরা নানান শিক্ষনীয়, মানবিক কাজ করার চেষ্টা করি। করোনা মোকাবিলায় আমরা এখন ইউনিয়নের ২৬ টা গ্রামে মাইকিং করেছি, লিফলেট বিতরণ করেছি। শিগগিরই ডাল আর সাবান অসহায় মানুষের বাড়িতে পৌছে দিবো ইনশাআল্লাহ্।