সিনেমাকেও হার মানায় হাসির হারিয়ে যাওয়ার গল্প

  © টিডিসি ফটো

১৮ বছর পরে হাসি ফুটেছে হাসি (২৩) আক্তারের মুখে। ছোটবেলায় নিখোঁজের ১৮ বছর পর বাবা-মাকে খুঁজে পেলেন হাসি আক্তার নামের তরুণী। পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে অনাথ আশ্রমের চার দেয়ালে ১৮ বছর কেটেছে তার। আপন বলতে কেউ ছিল না। ছিল না পরিচয় দেয়ার মতো তেমন কিছু।

প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর গাইবান্ধা সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি পান হাসি। তখনো নিজেকে এতিম বলেই জানতেন হাসি। অনাথ আশ্রম থেকে বেরিয়ে চাকরি জীবন ভালোই কাটছিল তার। ইতোমধ্যে গত ১৮ অক্টোবর নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার চৌখালী গ্রামের বাসিন্দা রায়হান হাসান তুষারের সঙ্গে বিয়ে হয় হাসির।

বিয়ের এক মাসের মধ্যে স্বামী রায়হান হোসেন তুষারের কাছ থেকেই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে আনন্দের সংবাদটি পান হাসি। ১৮ বছর আগে হারানো বাবা-মায়ের সন্ধান দেন তুষার। অনেকটা স্বপ্নের মতোই লাগছিল, বিশ্বাস হচ্ছিল না কিছুতেই। অবশেষে স্বামীর মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে দেখা করে হাসি জানলেন এতিম নন, পরিবার এবং বাবা-মা আছে তার। জীবনের ১৮ বছর পরিবারহীন থাকার পরে এক্ষণে এসে হাসি বুঝলেন তার সবই আছে। তাই হাসি নামের স্বার্থকতায় ঠোঁটের ফাঁকে ঝিলিক মেরে ওঠে এক চিলতে হাসি।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা খানখানাপুর ইউনিয়নের মল্লিকপাড়া গ্রামের মো. খলিলের নাতনি হাসি আক্তার। ১৮ বছর পর হারানো হাসিকে নিজেদের মাঝে ফিরে পেয়ে যেন আনন্দে আত্মহারা মা খাদিজা বেগম, নানা খলিল ও মামা সাইদুলসহ গোটা এলাকাবাসী। এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন পরিবারের সবাই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ১৮ বছর আগে পাঁচ বছর বয়সে রাজবাড়ী থেকে ট্রেনে দাদির সঙ্গে রাজশাহীতে বাবার বাড়ি যাচ্ছিল হাসি। ওই ট্রেনেই হারিয়ে যান তিনি। এরপর বাবা-মা কিংবা পরিবারের কাউকে খুঁজে পাননি। ওই সময় শুধু মায়ের নাম খাদিজা বেগম, বাবার নাম হাসেম আলী, নানার নাম খলিল, মামার নাম সাইদুল ও দুলু এবং নানা বাড়ি ‘খানখানপুর’ বলে জানতো হাসি। কিন্তু তাকে ওই ঠিকানায় কেউ নিয়ে যায়নি। তাকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে, হাসিকে হারিয়ে ফেলার পর থেকে মাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় হাসির বাবা। দীর্ঘদিন ধরে তাকে ঘরে না তোলায় এক সময়ে হাসির মাকে বিয়ে দেন তার নানা-নানী।

এদিকে, চলতি বছর গাইবান্ধা সরকারি শিশু পরিবারে অফিস সহকারী পদে চাকরি হয় হাসির। গত ১৮ অক্টোবর নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার চৌখালী গ্রামের বাসিন্দা রায়হান হাসান তুষারের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।

বিয়ের পর হাসির কাছে ছোটবেলার স্মৃতি ও হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুনতে চান স্বামী তুষার। তখন হাসি স্বামীকে বলেন, ‘খানখানপুর এলাকা, নানা খলিল ও মামা সাইদুল। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারি না।’ পরে গুগল ও ফেসবুকের মাধ্যমে ‘খানখানপুর’ সন্ধান করেন তুষার। এ সময় তিনি দেখতে পান রাজবাড়ীতে ‘খানখানাপুর’ বলে একটি ইউনিয়ন রয়েছে। সেখান খোঁজ করতে করতে মিলে যায় হাসির পরিবারের সন্ধান। শনিবার দুপুরে স্ত্রীকে নিয়ে রাজবাড়ীতে আসেন তুষার।

পরিবারের কাছে হাসিকে তুলে দেয়ার সময়

পরে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) দিলসাদ বেগম, পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, প্রেসক্লাবের সভাপতি খান মো. জহুরুল হক নানা-নানি ও মামার হাতে হাসিকে তুলে দেন। এরপর হাসি, স্বামী তুষার, চাচা শ্বশুর জাহাঙ্গীর আরিফকে বাড়ি নিয়ে যান হাসির নানা। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর হাসিকে দেখতে শত শত মানুষের ভিড় জমে। এ সময় হাসিকে জড়িয়ে ধরে অনেকেই আবেগাপ্লুত হন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসির স্বামী তুষার বলেন, পরিবারের কেউ নেই জেনেই ১৮ অক্টোবর হাসিকে বিয়ে করি। এরপর হাসির কাছে ছোটবেলার স্মৃতি জানতে চাই। তখন নানা, মামা ও এলাকার নাম বলে ও। মূলত এলাকার নাম সঠিক বলতে পারছিল না হাসি। খানখানাপুরের স্থলে খানখানপুর বলেছিল। পরে গুগল ও ফেসবুকের সাহায্যে রাজবাড়ীর খানখানাপুরের সন্ধান পাই। শনিবার রাজবাড়ীতে এসে ১৮ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া হাসির পরিবারকে এত সহজে পাব কল্পনাও করিনি।

নিজের অনুভূতি জানিয়ে হাসি আক্তার বলেন, ছোটবেলায় ট্রেন থেকে হারিয়ে যাই। এরপর রাজশাহী ছোটমনি নিবাস, সেখান থেকে গাইবান্ধা সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা) বেড়ে উঠি। সেখানেই পড়াশোনা করি। ওই সময় অনেকের অভিভাবক আশ্রমে আসতো, শিশুদের সঙ্গে দেখা করতো। কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা করতে কেউ আসতো না। মনের মধ্যে চাপা কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছি আমি। কোনোদিন ভাবিনি হারানো পরিবারকে খুঁজে পাব। কারণ একটা দীর্ঘ সময় নিজেকে এতিম বলেই জানতাম।

আনন্দের সংবাদ জানিয়ে হাসি বলেন, সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সরকারি চাকরি পাই। পরে তুষারের সঙ্গে বিয়ে হয়। মূলত স্বামীর সহায়তায় হারানো বাবা-মা, নানা-নানি, মামাসহ সবাইকে খুঁজে পেয়েছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। স্বামী তুষারের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ১৮ বছর পর সবাইকে কাছে পেয়ে আমি সত্যিই অনেক অনেক আনন্দিত।

হাসির মা খাদিজা বেগম বলেন, ১৮ বছর পর হাসিকে খুঁজে পাব ভাবিনি। আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। হাসি হারিয়ে যাওয়ার পর অনেক কেঁদেছি। আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থনা করেছি যেন মেয়েকে খুঁজে পাই। অবশেষে আল্লাহ সে ডাকে সাড়া দিয়েছেন।

হাসিকে হারিয়ে স্বামীর কাছ থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয় জানিয়ে খাদিজা বেগম আরো বলেন, পাঁচ বছর বয়সে দাদির সঙ্গে রাজশাহীতে যেতে গিয়ে ট্রেনে হারিয়ে যায় হাসি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে খুঁজে পাইনি। দীর্ঘদিন হাসির বাবা আমাকে না নেয়ায় আমাকে বিয়ে দেন বাবা-মা। হঠাৎ জানতে পারলাম হাসি বেঁচে আছে। হাসিকে কাছে পেয়ে আমার মনটা ভরে গেল।


সর্বশেষ সংবাদ