অন্যের বাড়িতে কাজ করা মামুন আজ বিসিএস ক্যাডার

তরুণ ডাক্তার আল মামুন। সদ্য প্রকাশিত ৩৯তম বিসিএসে গেজেটভুক্ত হলেন। নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি পিতা খোরশেদ আলমকে সহযোগিতা করে চালিয়ে নিয়েছেন অভাবের সংসার। কখনও ভ্যান চালিয়ে, কখনও হাটে সবজি বিক্রি করে, কখনও অন্যের বাড়িতে গৃহপরিচারকের কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন। এত কিছুর মধ্যেও থেমে যায়নি তার স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার।

মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত গেজেট অনুযায়ী- ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৪ হাজার ৪৪৩ জন ভাগ্যবান চিকিৎসকের একজন ডা. আল মামুন।

চেষ্টা থাকলে উপায় হয় কথাটি কতটা সত্য তা প্রমান করলেন রিক্সা চালক বাবার ভ্যান চালক ছেলে মানিকগঞ্জ জেলার তরুণ চিকিৎসক ডা. আল মামুন। আজ দেশের প্রথম শ্রেণীর সরকারী গেজেটেড চিকিৎসক তিনি।

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই ছিল কিনা প্রশ্নে ডা. আল মামুন বলেন, ঠিক তা নয়; সে সময় চিকিৎসক হব এমনটা কল্পনা করিনি। চড়াই উতরাই করে স্বপ্ন পরিবর্তন হতে থাকে আমার। সেই যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, তখন চাইতাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক হব। যখন হাইস্কুলে গেলাম তখন চেয়েছি হাইস্কুলের শিক্ষক হব। এভাবেই জীবন এগিয়েছে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না।

তার সফলতার পেছনে শুধু নিজের সংগ্রাম ও অদম্য ইচ্ছাকেই মূল কারণ নয় বললেন ডা. আল-মামুন। নানা বিপদে স্থানীয়দের এবং কলেজের অবদানের কথাকে ভুলেননি তিনি।

গেজেটে নিজের নাম দেখে আবেগে আপ্লুত ডা. আল মামুন। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকেই অনেক প্রতিকূলতার মাঝে, দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে লেখাপড়া চালিয়ে এসেছি। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে আমি বড়। যেখানে আমার গ্রামে ডাক্তার বলতে ওষুধের দোকানদারকেই বুঝে, সেই গ্রাম থেকে আমি আজ সরকারী ভাবে ৩৯ তম বি সি এসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে গেজেটেড হলাম।

তিনি বলেন, মনে পড়ে এসএসসি পরীক্ষার সময় বোর্ডের ফিস দেয়ার সামর্থ ছিল না আমার। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু টাকা জোগার করতে পারছিলাম না। এসময় আমাদের উপজেলার চেয়ারম্যান আমাকে ফিসের টাকা দেন। আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। গোল্ডেন এ+ পেলাম। শিক্ষকরা এমন রেজাল্টে খুব খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। শ্রদ্ধেয় স্যাররা ফ্রি প্রাইভেট পড়িয়েছেন আমাকে। স্যারদের প্রতি আমি সব সময় কৃতজ্ঞ।

তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর ভ্যানে সবজি বিক্রি করে সংসারের খরচ জোগাড় করছিলাম। ফলাফলের দিন শুনলাম গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। আর আমার স্কুল হতে আমার ব্যাচই প্রথম এ + পেল। স্যাররাও খুব খুশি। কিন্তু তখন সবজি বিক্রিতেই মনযোগী। এইচএসসি পড়তে পারব কিনা, কোথায় ভর্তি হবো, কী করব? কিছুই জানি না। এর মাঝে একদিন হঠাৎ গ্রাম সম্পর্কিত এক দাদুর কাছে শুনতে পেলাম ঢাকার ক্যামব্রিয়ান কলেজে গরিব মেধাবীদের ফ্রি পড়াবে। দাদু আমাকে ঢাকা নিয়ে এলেন। সেটাই আমার প্রথম ঢাকায় আসা। ক্যামব্রিয়ান কলেজে নিয়ে গেলেন আমার গ্রাম সম্পর্কীয় এক কাকা। ভর্তি করিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ বিনা বেতনে ২ বছর পড়ার সুযোগ পেলাম। সেই কাকার বাসায় থেকেই আমি এইচএসসি পড়েছি। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। তার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না।

ডা. আল মামুন বলেন, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে চান্স পেলাম। কিন্তু ভর্তি হওয়ার জন্য ৬ হাজার টাকা ছিল না আমার। এই খবর শুনে সেই টাকা দিলেন আমার গ্রাম সম্পর্কীয় আরেক দাদু। তার টাকায় মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ফরিদপুর অনেকগুলো টিউশনি নিলাম। টিউশনির টাকা দিয়ে আমি নিজের খরচ চায়িয়ে নিতাম, বাড়িতে ভাইবোনদের জন্যও পাঠাতাম। আমার দুই বোনকে সরকারিভাবে নার্সিং এ ডিপ্লোমা পড়িয়েছি সেই টাকা দিয়েই। তারা এখন দু’জনেই ঢাকায় চাকরি করেন। সব মিলিয়ে আজ আমার ডাক্তার হওয়ার পেছনে গ্রামবাসীর বিভিন্ন জনের কাছে ঋণী আমি।

ডা. আল মামুন আরও জানান, সেসব কথা মনে করে আবেগে সবাইকে বলি আমি রিকসাচালকের দরিদ্রপীড়িত সংসারের সন্তান হয়ে আজ এতদূর এসেছি। তাতে অনেকেই বিষয়টাকে নেতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটা সমাজের অন্যসব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বার্তা। তারাও যেন এভাবে সংগ্রাম করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। দেশের জন্য কিছু করতে পারে।

সরকারিভাবে প্রায় ৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের মতো এতো বড় একটি পদক্ষেপের বিষয়ে বর্তমান সরকার ও বিশেষকরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান ডা. আল মামুন।

জানা যায়, মানিকগঞ্জের পশ্চিম হাসলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয় আল মামুনের। এরপর মানিকগঞ্জ সদরের লেমুবাড়ী বিনোদা সুন্দরী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে এসএসসি পাস করেন। এমন রেজাল্টে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তার। দরিদ্র কোটায় বিনা খরচে এইচএসসি সম্পন্ন করেন ঢাকার ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে। এরপর ভর্তির সুযোগ পান ফরিদপুর মেডিকেল কলেজেরর ২০ তম ব্যাচে। সেখান থেকেই আজ তিনি সরকারিভাবে ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে গেজেটেড হলেন।

তিনি জানান, আজ দেশের মানুষকে আমার অনেক কিছু দেয়ার সময় এসেছে। সে সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সবার কাছে দোয়া চাই যেন একজন ভালো মানবিক ডাক্তার হতে পারি।

 


সর্বশেষ সংবাদ