ফাল্গুনী পেরেছে, ফাল্গুনীই পারবে

  © টিডিসি ফটো

তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন দুই হাত। শিক্ষাজীবনে এসেছে অসংখ্য বাধা। তবুও দমে যাননি। জীবন সংগ্রামের নানা ধাপ অতিক্রম করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফলাফলের মাধ্যমে অনার্স শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩.৫০ সিজিপিএ নিয়ে বর্তমানে অফিসার পদে চাকরি করছেন এই অদম্য মেধাবী।

জীবন সংগ্রামে সফল এই অদম্য মেধাবী মুখ ফাল্গুনী সাহা। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার গলাচিপায়। বাবার নাম জগদীশ চন্দ্র সাহা, মা ভারতী সাহা।

জানা যায়, তখন সবে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ফাল্গুনী। সমাজের অন্য দশটি বালকিার মতোই হেসে-খেলে বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তার জীবনে নেমে আসে মস্ত বড় বিপদ। সময়টা ২০০২ সাল। পাশের বাড়ির ছাদে বন্ধুদের সাথে খেলার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাতের কনুই পর্যন্ত পুড়ে যায়। দেশের চিকিৎসায় ভালো না হওয়ায় একসময় পাশ্ববর্তী দেশে নেয়া হয় তাকে।

পড়ুন: ৭ মামলার আসামি সেই কাউসার ইংরেজিতে পড়বেন

তত দিনে তার হাতে পঁচন ধরে গেছে। সেখানকার ডাক্তার বলেন, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এভাবে পঁচতে থাকলে এক সময় ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে। তাই হাতের পঁচা অংশ কেটে ফেলতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর কনুই থেকে কেটে ফেলা হলো ফাল্গুনীর দুই হাত।

এরপর থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ তিনি সফল। শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে পড়াশুনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। সেখান থেকে অনার্সে ৩.৫০ সিজিপিএ নিয়ে বর্তমানে স্নাতকোত্তর পর্বে অধ্যয়নরত আছেন।

তার হাত দুটি নেই বললেই চলে। কিন্তু তাতে দমে যাননি ফাল্গুনী। এখন তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স অফিসার। এক সময় মানুষ, সমাজ তাকে বোঝা মনে করলেও তিনি ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের সক্ষসতা। জানান দিয়েছেন নিজের ভেতরের প্রতিভাকে। সকলকে বুঝিয়েছেন, প্রমাণ দিয়েছেন নিজের যোগ্যতার।


একটা সময় প্রতিবেশীরা আফসোস করে বলত, আহা মেয়েটার আর পড়াশোনা হবে না। তবে ফাল্গুনী দমে যাওয়ার পাত্রী নন। কাগজ-কলম দেখলে মন খারাপ হতো। সহপাঠীদের স্কুলে যেতে দেখলে চোখের কোণে জল আসত। ভাবতেন, ‘পৃথিবীতে কিছুই তো অসম্ভব নয়। তবে আমি কেন পারব না?’ একদিন সাহস করে কলম নিয়ে খাতার ওপর লিখতে চেষ্টা করলেন। এভাবে কিছুদিন প্র্যাকটিস করলেন। পরে একদিন দুই হাতের কনুইয়ের মাঝখানে কলম রেখে লেখার কৌশল আয়ত্তের চেষ্টা করলেন। প্রমাণ করলেন- ‘ফাল্গুনী পেরেছে, ফাল্গুনীই পারবে’।

পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষকদের সন্তানের শিক্ষা ভাতা কর্তন

এ বিষয়ে ফাল্গুনী বলেন, শুরুতে ভীষণ কষ্ট হতো। এলোমেলো হয়ে যেত লাইন। কলম ধরতে ধরতে একসময় হাতে ইনফেকশনও হয়েছিল। ডাক্তারও বারণ করেছিলেন এভাবে লিখতে। তবে আমি হার মানিনি। অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে একসময় ঠিকই লেখা আয়ত্তে চলে আসে।

ফাল্গুনী তার বিচিত্র শিক্ষাজীবনেও রেখেছিলেন নানমুখী প্রতিভা এবং দক্ষতা ও সক্ষমতার স্বাক্ষর। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে দমে যাননি। বরং হাসিমুখে প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নিয়ে এগিয়ে গেছেন স্বপ্নের একেকটি সিঁড়ি বেয়ে।

আহত হওয়ার পরের বছর তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ফাল্গুনী। গলাচিপা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেলেন। গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে (এসএসসি) জিপিএ ৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এর পরে চারদিক থেকে বাহবা আসতে থাকে। ফাল্গুনীর কথা জানাজানি হলে অধ্যক্ষ বশির আহমেদ তাকে ঢাকায় এনে ঢাকার ট্রাস্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। কলেজের হোস্টেলেই থাকতেন। এখান থেকে এইচএসসিতে মানবিকে জিপিএ ৫ পেয়ে ফাল্গুনী প্রমাণ করলেন, মানুষ চাইলে সবই পারে! পরীক্ষাকেন্দ্রে তার জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হাত না থাকয় কনুইদ্বয়ের মাঝে কলম চেপে ধরে লিখতেন তিনি।

পড়ুন: তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ইয়ামিনের চোখে শুধুই দুঃস্বপ্ন

উচ্চমাধ্যমিকে (এইচএসসি) অভাবনীয় ফলাফলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ের সময় ফার্মগেটে ছিলেন কিছুদিন। পরে সূত্রাপুর ও লালবাগে দুই আত্মীয়ের বাসায় থেকেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার স্বপ্ন থাকলেও সে সুযোগ তার ভাগ্যে জোটেনি। পরে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। অনার্সে সিজিপিএ ৩.৫০ পেয়েছেন। এখন সেখানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।

জানা গেছে, চার বোনের মধ্যে ফাল্গুনী তৃতীয়। ছোটখাটো একটি মুদি দোকান ছিলো তার বাবার। তবে তাদের আবার দুর্ভাগ্য নেমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পর বাবাকে হারান ফাল্গুনী। তখন তিনি সবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছেন আর তার ছোট বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী। দুই মেয়েকে নিয়ে মা ভারতী সাহা যেন অথৈ জলে পড়লেন। মিষ্টির বাক্স বিক্রি করে কোনো মতে সংসার চালাতেন। সাপ্তাহিক এবং অন্যান্য ছুটিতে বাড়ি গেলে এ কাজে মাকে সাহায্য করতেন ফাল্গুনী।

অভাবের সে দুঃসময়টির সম্পর্কে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম বর্ষে পড়ার সময় জাবির অদূরে সাভারে মাসে দেড় হাজার টাকায় একটি টিউশনিও পেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ধারণা, আমার হাত দুটি নেই। লিখতেও কষ্ট হয়। তাই আমি পড়াতে পারব না! তাই মাস দুয়েকের বেশি টিউশনিটা চালিয়ে নিতে পারিনি। টিউশনি চলে যাওয়ার পর চরম অর্থকষ্টে কাটে কিছুদিন। পরে এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী চন্দ্র নাথের সঙ্গে। সেখান থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা হলো।

পড়ুন: তেলচিত্রে শাখারি বাজার, বর্ষসেরা ঢাবি ছাত্রের ছবি

ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফাল্গুনী বলেন, ফাউন্ডেশন থেকে প্রতি মাসে যা পেতাম তা দিয়ে খরচ মিটে যেত। সত্যি বলতে কী, ওই সময় বৃত্তি না পেলে হয়তো পড়াশোনায়ও ইস্তফা দিতে হতো। পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে সব সময় সহযোগিতা পেয়েছি। সবার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। চাকরির ব্যাপারটি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, পড়াশোনার সময় তো বৃত্তির টাকাতেই চলেছি। কিন্তু মাস্টার্স শেষে কী হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এর মধ্যেই গত ১৭ অক্টোবর একটি সুখবর পাই। বেসরকারি সংস্থা ‘ব্র্যাক’-এ ‘হিউম্যান রিসোর্স অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আমাকে। আগামী মাসের ৩ তারিখে যোগদান করার কথা।

পরিবারের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে ফাল্গুনী বলেন, আমার মা অনেক অসুস্থ। বসে বসে কাজ করতে গিয়ে তার হাড় ক্ষয়ে গেছে। কিছুদিন আগে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছেন। মাকে ভালো ডাক্তার দেখাব। ছোট বোন অনার্সে পড়ছে। তাকেও সহযোগিতা করতে হবে।

জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করে এসে ফাল্গুনী সাহা বলেন, অনেক কষ্ট করে জীবনে এই অবস্থানে এসেছি। ইচ্ছাশক্তির জোরে এতো দূর আসা।

আরো পড়ুন:

আল্লাহ আমাকে মাফ করে দিও- বলে কালেমা পড়ে ভাইয়া: ফাইয়াজ

ঘাতক শামীমকে টিউশন দিয়েছিল আবরার

সন্তানকে বীভৎসভাবে মারছে গৃহকর্মী, ক্যামেরায় দেখছেন বাবা (ভিডিও)

 


সর্বশেষ সংবাদ