ওরা দেখে না, কিন্তু বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিল

হাফেজ ইমাম হাসান, হাফেজ ইয়াছিন আরাফাত ও হাফেজ জাহিদুল ইসলাম
হাফেজ ইমাম হাসান, হাফেজ ইয়াছিন আরাফাত ও হাফেজ জাহিদুল ইসলাম

ওরা তিনজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। ওদের কারো বয়স এখনও পনেরো পার হয়নি। জন্মের পর থেকে পৃথিবীর কোনো কিছুই চোখে দেখেনি ওরা। কিন্তু ইতোমধ্যে ওরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন সম্পূর্ণভাবে মুখস্ত করে বিশ্ব মুসলমানদের দেখিয়ে দিয়েছে। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ওরা এখন কুরআনের হাফেজ। লক্ষ্মীপুরের ‘আবদুল গণি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্রেইল হাফিজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসা’র ছাত্র হাফেজ মোহাম্মদ ইমাম হাসান, ইয়াছিন আরাফাত ও জাহিদুল ইসলামের কথা।

হাফেজ ইমাম হাসান লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাসিন্দা মহিব উল্লাহর ছেলে এবং হাফেজ ইয়াছিন আরাফাত সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল করিমের ছেলে। জাহিদুল ইসলাম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপুর গ্রামের মরহুম মোহাম্মদ কবির হোসাইনের ছেলে।

২০১৬ সালে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হাফেজ মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের বাবা মারা যান। তার বাবা তাকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। যে কারণে তিনি প্রথম দিকে বাড়ির বাইরে কোথাও রেখে জাহিদকে পড়ানোর বিষয়ে আপত্তি করেছিলেন। পরে অবশ্য নিজেই ছেলেকে মাদ্রাসার আবাসিকে রেখে যান। ছেলে একদিন কুরআনে হাফেজ হবে এটাই ছিল তার স্বপ্ন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছোট্ট জাহিদ তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে। কুরআনের ত্রিশটি পারা সম্পূর্ণ মুখস্ত করতে মাত্র তিন বছর সময় লেগেছে তার। আজ জাহিদ একজন কুরআনে হাফেজ। আগামী রমজান মাস থেকে তিনি খতমে তারাবি পড়াবেন। যদিও তার বাবা এই সফলতা দেখে যেতে পারেননি। তবুও সন্তানকে সঠিক শিক্ষাদানে জাহিদের মরহুম বাবা সফল হয়েছেন বলে মনে করছেন ইসলামী চিন্তাবিদগণ।

এদিকে হেফজ সম্পূর্ণ করার পর গত দুই বছর ধরে আল কুরআনের তাফসীর ও হাদিস গ্রন্থসমূহ নিয়ে পড়াশুনা করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইমাম হাসান ও ইয়াছিন আরাফাত। সব ঠিক থাকলে আর পাঁচ বছর পরেই তারা হয়ে উঠবেন আল কুরআনের তাফসীরকারক। তারা আলোচনা করবেন, বক্তব্য রাখবেন ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুর পৌর শহরে অবস্থিত ‘আবদুল গণি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্রেইল হাফিজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ব্রেইল পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। এ প্রতিষ্ঠানে মাওলানা শামছুজ্জামান মাহমুদ, হাফেজ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ক্বারী আবদুল মোহাইমেন-এর তত্ত্বাবধানে নাজরানা, হাফিজিয়া ও কিতাব শাখায় মোট ১৭ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্র অধ্যয়নরত রয়েছে। এখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্রদের ভর্তি, থাকা-খাওয়া ও পড়ালেখা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। স্থানীয়দের দান-অনুদানেই মাদ্রাসাটি চলছে।

ব্রেইল ক্বারী আবদুল মোহাইমেন (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী) বলেন, একসময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা তাদের ওস্তাদের মুখ থেকে শুনে শুনে কুরআন মুখস্ত করতো। ১৯৯৫ সালে প্রথম রাজধানী ঢাকায় আল মারকাজুল ইসলামী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্রেইল হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুরের আবদুল গণি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্রেইল হাফিজিয়া ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ব্রেইল পদ্ধতি চালু হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা আরবীর পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজী ও গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করছে।

মাদ্রাসাটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা হারুন আল মাদানী বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পরিবার কিংবা দেশের বোঝা নয়। সুষ্ঠু পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ পেলে তারাও ভালো কিছু করে দেখাতে পারে। ইতোমধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফ সম্পূর্ণ মুখস্ত করে হাফেজ হয়েছেন আমাদের তিনজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। এ মাদ্রাসায় আরও ১৪ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নাজরানা ও হেফজ বিভাগে অধ্যয়নরত রয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং টিকিয়ে রাখা খুবই প্রয়োজন। এজন্য যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন তারা নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তা’য়ালার নিকট থেকে উত্তম প্রতিদান পাবেন বলে মন্তব্য করেন এই ইসলামী চিন্তাবিদ।

সচেতন নাগরিক কমিটি লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মাহাবুব মোহাম্মদ আলী বলেন, সঠিকভাবে কুরআন মুখস্ত করা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ শিক্ষা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও এ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে শুনে খুবই ভালো লাগছে। লক্ষ্মীপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ব্রেইল পদ্ধতির একটি স্কুল চালু রয়েছে। স্কুলটির নাম ‘দালালবাজার সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’। স্কুলটিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনা করছে। একইভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লক্ষ্মীপুরে ব্রেইল পদ্ধতির একটি মাদ্রাসা চালু করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।