মেরে ফেলতে চাওয়া সেই সন্তান আজ হার্ভার্ডের ছাত্র
- মনিজা রহমান
- প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৩২ PM , আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০১৯, ১০:০৯ PM
লেখাটা যখন প্রথম পড়লাম চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সারা শরীরের লোমকুপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অন্যরকম আবেগে। পৃথিবীতে এমন মা কজন আছেন, যিনি সমস্ত প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে সন্তানকে এত দূর নিয়ে আসতে পারেন। গর্ভপাত করে সন্তানকে নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল ডাক্তাররা। মা সেই নির্দেশ শোনেননি। সেরিব্রাল পালসি সেই সন্তানকে একা লালন পালন করেছেন। ছেলের ভালো স্কুলের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে এক সঙ্গে তিনটি চাকরি করেছেন। যত দুর্যোগময় আবহাওয়া হোক ছেলেকে নিয়ে গেছেন থেরাপি সেন্টারে। এত কষ্টের ফল তিনি পেয়েছেন। মায়ের সেই ছেলে আজ হার্ভার্ডের ছাত্র।
মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীতে যে কত বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনাটি তার আরেক প্রমাণ। যদি আপনি প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতা-মাতা হন, তাহলে আপনাকে অন্যরকম শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগাবে এই ঘটনা। অসামান্য সেই মায়ের নাম- জোউ হংগুয়ান। ১৯৮৮ সালে মধ্য চীনের এক হাসপাতালে একমাত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু সন্তান ডিংডংয়ের জন্মকালীন সময়টা আনন্দদায়ক ছিল না। নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। যে কারণে শিশুটির জন্মাবার সময় অক্সিজেনের অভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হয়।
সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত ডিং
জন্মকালীন এই ধরনের জটিলতা থাকলে শিশুরা সাধারণত সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত হয় । তখন হুবেই প্রদেশের ডক্টররা শিশুটিকে পৃথিবীর আলো না দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। একটি সদ্যোজাত শিশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণের কারণ কি ? কারণ এই শিশু বড় হবার পরে হয় প্রতিবন্ধী, নয়তো নিম্নমানের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে উঠবে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডাক্তাদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়ে যায় শিশুটির বাবা। সেও মনে করে, বড় হয়ে তার এই সন্তান তাদের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিবে। কিন্তু মা জো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল, এই শিশুকে সে বড় করবে। পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। জো একা মা হিসেবে সন্তানকে বড় করে তোলে।
সন্তানের পড়াশুনা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য মা জোউ এক সঙ্গে তিনটি চাকরি করতো। এরমধ্যে ছিল হুয়ান কলেজে ফুল টাইম চাকরি। এর পাশাপাশি প্রটোকল ট্রেনার ও ইন্সুরেন্স এজেন্টের পার্ট টাইম চাকরি করতো সে। ছেলের জন্য মা এমন কোন কাজ নেই করেনি। একাই সমস্ত বাধা বিপত্তিকে মোকাবিলা করেছে। একাই ছেলেকে সে রিহ্যাবিলেটেশন সেন্টারে নিয়ে যেত। আবহাওয়া যত দুর্যোগময় হোক ছেলেকে নিয়ে সে যাবেই যাবে। নিজেও সে ‘মাসাজ’ এর প্রাথমিক নিয়মকানুন শিখে নেয়। ছেলের শরীরের যে অংশে কোন কার্যক্ষমতা ছিল না, সেখানে বাড়িতে ‘মাসাজ’ করতো সে। তারপরে অবসরে সময় পেলে নানা ধরনের ‘পাজল’ খেলতো। বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পায় এমন গেমগুলি খেলতো দুজনে মিলে।
ডিং চপস্টিক দিয়ে খাবার খেতে পারতো না। তখন জোউয়ের আত্নীয়রা বলল, দরকার নেই ওর চপস্টিক ব্যবহার করার। কিন্তু জোউ তাদের কথা না শুনে ধৈর্যের সঙ্গে ছেলেকে চপস্টিক দিয়ে খেতে শেখালো। এই নিযে জোউ বলেছে, ‘আমি কখনও চাইনি শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমার ছেলে লজ্জিত হোক। এমনিতে সে অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেলের প্রতি আমি কঠোর হয়েছি। যদিও তার পক্ষে চপস্টিক ধরা সহজ ছিল না। কিন্তু যেখানে তার সমস্যা আছে আমি সেখানে সাহায্য করেছি।’
মায়ের সেই ত্যাগ ও পরিশ্রম বৃথা যাইনি। ডিং পড়াশুনায় ভালো করতে থাকে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’ থেকে ২০১১ সালে সে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়। এখন সে বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভার্ডের আইন বিভাগের ছাত্র। এখন সবাই ডিংয়ের মায়ের প্রশংসায় মুখর। কারণ সে সন্তানকে জন্মের সময় ত্যাগ করেনি। ডাক্তারদের বলেনি, সন্তানকে মেরে ফেলতে।
মনিজা রহমান
২৪ আগস্ট, ২০১৯
ইস্ট রিভারের তীর থেকে