নন-ক্যাডার ও আমার পাঁচ বিসিএস ব্যর্থতার গল্প

  © টিডিসি ফটো

বিসিএস শুধু একটি পরীক্ষার নাম নয়; একটি স্বপ্নের নাম! এক নৈসর্গিক নিরলোকি নেশার নাম! যে নেশা একবার পেয়ে বসলে ছাড়তে চায় না। ক্যাডার হওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত কিংবা বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনের জন্য বয়সের শেষ সায়াহ্ন অবধি এই নেশা অনেকেই অন্ধের ন্যায় আকৃষ্ট করে রাখে! এ নেশা নান্দনিক নেশা! এ নেশা নিঃশেষ হওয়ার নেশা! এ নেশা নাম, যশ, খ্যাতি, মান-সম্মান, বিত্ত আর চিত্তের নেশা! এ নেশায় বুঁদ হয়ে অনেক এগিয়ে যায় আবার কেউবা বহুগুণ পিছিয়ে যায়! এ নেশায় যে বিজয়ী হয় সে সবার জয়োধবনি, হাততালি কুঁড়ায়! আর যে বিজিত হয় সে হয় হতাশাগ্রস্ত, লজ্জিত। নিজেকে নিজের কাছ থেকে লুকিয়ে আড়াল করে ফেলে পরাজিত হওয়ার অপমানবোধে!

পৃথিবী তাঁদেরই বরণ করে, স্মরণ করে যারা বিজয়ী, যারা বীর! সম্ভবত নেপোলিয়ন বেনাপোর্টই বিশ্বে একমাত্র ব্যক্তি যেঁ পরাজিত হয়েও আজও সবার স্মরণীয়! কারণ ওয়াটার লু যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটন যে জয় লাভ করেছিল তাঁর নামটি অনেকেই জানেনা! আমরা কি নেপোলিয়ন? যে আমরা পরাজিত হলেও এই পৃথিবী আমাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে! বিসিএসের স্বপ্ন বা নেশা আমাকেও পেয়ে বসেছিল। সেই স্বপ্ন থেকেই একে একে ৫টি বিসিএস পরীক্ষায় অংগ্রহণ করি! কিন্তু বিজয়ী হয়ে বিশ্বের বুকে বীরত্বগাঁথার নাম লেখাতে পারলাম না! ফলাফল অশ্বডিম্ব! বারবার ব্যর্থ! এই ব্যর্থতার ভিতরে আছে সত্যিকার গল্প। আমার মত সবার জীবনে নিশ্চয় এমন দুঃখ গাঁথা আছে! যা নীরবে, নিঃশব্দে, অগোচরে সবাই ভয়ে বেড়ায়! শুধু জানার জন্য বিসিএস নিয়ে আমার সেই অজানা দুঃখ গাঁথার গল্প অন্য সকলের জন্য তুলে ধরলাম-

১। ভোর হলেই প্রথমবারের মত অংশগ্রহণ করব বিসিএস লিক্ষিত পরীক্ষায়। হঠাৎ পিএসসি’র ব্জ্রপাত! আগামীকাল লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না! প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ৩৩তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষার ১৪ ঘণ্টা পূর্বে পিএসসি সংবাদ সম্মেলন করে লিখিত পরীক্ষা ‘বাতিল’ ঘোষণা করে। দীর্ঘ প্রস্তুতি কাঁটা পড়ল প্রশ্ন ফাঁসের বেড়াজালে! মনে ভীষণ কষ্ট পেলাম! আপাততঃ আবশ্যিক পরীক্ষার ব্যস্ততা শেষ। তাই বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি জোড়েসোরে । কুরবানী ঈদের ঠিক দু’দিন পরে অনুষ্ঠিত হবে ৩৩তম বিসিএসের বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা। সে জন্য আমিসহ আমার অনেক বন্ধু ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে “ঈদ” উদযাপন করতে না গিয়ে ঢাকায় থেকে যাই। আমরা তখন বেনারশী পল্লী, সেকশন ১০, মিরপুরে থাকি। চাঁদ রাতে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হুমায়ূন কবির হিমুসহ মেসের অনেকে গল্প, আড্ডা আর গানকরে রাত ১২টার দিকে ঘুমাতে যাই। ঈদের দিন সকালে আমার ভীষণ অসুস্থ বোধ হচ্ছে। তাই ঈদের নামায পড়তে না গিয়ে একাই শুয়ে থাকি। আমার বন্ধু হিমুসহ বাকিরা ঈদের নামায পড়তে যায়। অসুস্থতার মধ্য দিয়ে কেটে যায় পুরো ঈদের দিন!

বিকালে আমার খুব কাছের দুই বন্ধু আমার জন্য ‘বিরিয়ানি’ করে নিয়ে আসে। আমি খেতে পারিনি। পরীক্ষার আগের দিন আমি কিছুটা সুস্থ হয়েছিলাম। তাই অনেক আয়েশ করে সন্ধ্যায় ইছেমত কুরবানির গোস্ত খেলাম। রাত ১০ টার দিকে আমার প্রচন্ড বমি বমি ভাব হচ্ছে! এক সময় আমি বন্ধুর বিছানায় প্রচুর বমি করি! আমার বন্ধু নিজ হাতে আমার সেই বমি পরিষ্কার করলো এবং রাতেই বিছানা ধুয়ে দিল। কিছুতেই আমার বমি বন্ধ হচ্ছে না! এভাবে বমি হতে হতে রাত ২ টা বাজলেও বমি বন্ধ না হওয়াতে আমার বন্ধু হুমায়ূন কবির হিমু এবং মামুন নামের এক ছোট ভাই আমাকে জরুরী ভিত্তিতে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করে। আমি হাঁটতে পারছি না বিধায় আমাকে অনেকটা কোলে নিয়ে হাসপাতালে যায় তারা! হাসপাতালে ভর্তির পর ডাক্তার একটি ইনজেকশন করলে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গার পর আমার আর বমি হয়নি। তখন রাত প্রায় ৩টা! আমার বন্ধু কবির হিমু এবং মামুন সারাক্ষণ পাশেই ছিল। তারা আমায় আবার কোলে করে বাসায় নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু অবাক করা বিষয় সকাল হলেই বিসিএসের মত একটি কঠিন পরীক্ষা জেনেও কোন পড়াশোনা না করে আমার ভাইতুল্য বন্ধু হিমু আমার জন্য এমন মহান কাজ করেছে! যা বন্ধুতো দূরের কথা অনেক আপন ভাইও করে না। পরের দিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। মাস খানেক পর পিএসসি আবার ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে ২০১২ ইং সালের ডিসেম্বর মাসে। লিখিত পরিক্ষা ফলাফলে উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভায় অংশগ্রহণ করি। চূড়ান্ত ফলাফলে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। প্রথমবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথমেই নন-ক্যাডার হিসাবে প্রথম “কষ্ট” পেয়েছিলাম! এ আমার প্রথম বিসিএসের দুঃখ গাঁথার গল্প! ভেবেছিলাম পর্রে বিসিএস পরীক্ষায় ঠিক ক্যাডার হব।

২। সেই মনোবাসনা নিয়ে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষা লিখিত অংশগ্রহণ করি মিরপুরের বাসা থেকেই। পরীক্ষা সবার ভালো হচ্ছে। প্রতিদিন ৮টা থেকে ৮টা ৩০ মিনিটে আমরা বাসা থেকে পরীক্ষায় দেয়ার উদ্দেশ্যে বের হই। প্রতিটি পরীক্ষায় সকালে আমরা ৩ জন মটরচালিত রিকশাযোগে পরীক্ষা দিতে হলে যাই। তো গণিত পরীক্ষার দিন! আমরা রেডি হয়ে মিরপুর ৬ নাম্বার রাস্তা হয়ে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে কমার্স কলেজের ঠিক কাছে এক ঢালুতে আমাদের রিকশার ব্রেক ফেল করে! রিকশা চালক কিছুতেই রিকশাটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। সেই সময় ব্যস্ত রাস্তায় অনেক গাড়ি আসছে-যাচ্ছে। রিকশাচলক হঠাৎ আমাদের বলল “মামারা, আপনারা শক্ত করে ধরেন, রিকশা থামাইতে পারছিনা”। আমরা ভয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে স্মরণ করছি। রিকশা চালকের বুদ্ধি ও দক্ষতার আমাদের কোন ক্ষতি হলো না। আমরা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাই। সে যাত্রায় আমরা ৩ জনই আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাই।চূড়ান্ত ফলাফলে আবার সেই অশ্ব ডিম্ব!

৩। ৩৫তম লিখিত পরীক্ষার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মিরপুরের বাসাটা ছেড়ে দেব। গ্রামে চলে আসব। আমার সহধর্মিনী এ বিষয়ে আমাকে আপ্রাণ সাহায্য করে। কারণ তাদের বাসা ঢাকা থেকে বেশি দূর নয়। তাই তাদের বাসায় থেকে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ইং পরীক্ষার দিন খুব সকালে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। বাসে উঠে মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। এমন শুনলাম বাসের চাকা পাংকচার হয়েছে! এই বাস আর যাবে না। কিছু সময় বসে থেকে বাধ্য হয়ে নেমে গেলাম অন্য বাসে উঠার জন্য । অফিস সময়ের কারণে রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। প্রতিটি বাসে অস্বাভাবিক ভিড়। অসহনীয় কষ্টে একটি বাসে উঠলাম। অনেক কষ্টে গুলিস্তান পৌছালাম। গুলিস্তান নেমে মিরপুরের বাসে উঠলাম ।

বাস মৎস্য ভবনের পর কেন যেন আচমকাই থেমে গেল! জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি রাস্তায় অসহনীয় জ্যাম! একটু একটু করে বাস শাহবাগের কাছাকাছি গেল। বাসটি ৩০মিনিট পরও শাহবাগ অতিক্রম করছে না! তখন ঘড়িতে ৯.৪০ মিনিট! নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল! আস্তে আস্তে নিজের মাঝে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। নিরুপায় হয়ে বাসে আর বসে না থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম।পরীক্ষার বাকি মাত্র ১২ মিনিট! ঘড়ি দেখে শুরু করি ভোদৌড়! বাংলামটর এসে আবার একটি গাড়িতে উঠি। কিন্তু ঐ গাড়িটিও জ্যামের জন্য কোনভাবেই কাওরান বাজার সিগন্যাল অতিক্রম করছে না। তাই পকেট থেকে বাসের কন্টাকটরকে ১০ টাকা দিয়ে নেমে পড়লাম বাস থেকে। আবার বাতাসে গতিতে দৌড়াতে লাগলাম! দৌড়াতে দৌড়াতে পরীক্ষার হলে পৌঁছালাম! আমি যখন পরীক্ষায় হলে পৌঁছাই তখন পরীক্ষার সময় ২ মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ঘামে ভরা ভেজা শরীরে পরীক্ষার খাতা নিয়ে মহান প্রভুর নামে লিখতে থাকলাম। আলহামদুল্লিলাহ পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছিল। ১৭ আগস্টের চূড়ান্ত ফলাফলে আবারও সেই নন-ক্যাডারে তকমা। অনেক স্বপ্ন ছিল ৩৫তম বিসিএসে ক্যাডার হব। কিন্তু সেই প্রথম কষ্টটি আমায় ছেড়ে ছাড়ল না। এবার শুধু কষ্ট নয়, অনেকটা মূর্তিমান পাথরে পরিণত হলাম। সম্মুখীন হলাম কঠিন থেকে কঠিন বাস্তবতার।

কারণ পরের দু’টি বিসিএসে প্রিলিতেই টিকিনি! তাই ৩৫তম বিসিএসই মনে হচ্ছে আমার শেষ আশ্রয়! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কেউ আমাদের জন্যে এগিয়ে আসেনি। আমাদের দুঃখ, কষ্ট নিয়ে কেউ লিখতেও চায়নি। তখনি জগন্নাথ বিশ্ববিদায়লয়ের অধ্যাপক পরম শ্রদ্ধেয় ডঃ মিল্টন বিশ্বাস স্যার আমাদের নিয়ে, আমাদের প্রাণের কথা সকলের নিকট অত্যন্ত সুন্দর, নিখুঁত লিখনিতে তুলে ধরেন। স্যার আমাকেও লিখতে দারুণভাবে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করে। জয় হোক জগন্নাথ বিশ্ববিদায়লয়ের অধ্যাপক ডঃ মিল্টন বিশ্বাস স্যারের। জয় হোক ৩৫তম বিসিএসে নন-ক্যাডারপ্রাপ্তদের। জয় হোক সকল নন-ক্যাডারদের।

[সংগৃহীত]


সর্বশেষ সংবাদ