৬ বছরে মা হারা প্রতিবন্ধী মাসুদের বিসিএস জয়ের স্বপ্ন

চবি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান
চবি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান

সময়টা ১৯৯৬ সাল। ৬ বছর বয়সে মাসুদের মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। পুরো পরিবার জুড়ে হাহাকার। এদিকে মাসুদের চোখের লাঞ্চে জমেছে পানি। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন দু’জনের চিকিৎসা একসাথে করানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। কয়েকমাস যাবৎ মাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে মাসুদের চোখের চিকিৎসা করা হয়নি। কিছুদিন পর মায়ের মৃত্যু হয়। শত চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর মাসুদও হারায় দুটি চোখ। যেই চোখ দিয়ে মাকে দেখা হবে না। সেই চোখ বোধহয় সৃষ্টিকর্তা মাসুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন!

চোখ হারানোর স্মৃতিটা যতটুকু মনে আছে সেটাই বলে যাচ্ছিলেন মাসুদ। টাকা পয়সার তুলনায় হারানো চোখ কত যে দামি— আজ হাড়ে হাড়ে বুঝছেন বাস্তবতা। তার পুরো নাম মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান। বাবা তারা মিয়া ছিলেন পেশায় একজন কৃষক। ২০১৪ সালে বাবাকে হারান। বাড়ী কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার শঙ্কুশা গ্রামে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ৩য় বর্ষে পড়ছেন। চবির শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ২১৬ নম্বর রুমে থাকেন।

নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাসুদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা সাধারণ শিক্ষার্থীর তুলনায় কতটা কষ্টকর। সেটা মাসুদের স্কুল পরিবর্তনের দৃশ্য দেখলেই অনুমান করা যায়। মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সালে নিজের চোখ দুটো হারালেও পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো। চোখ হারানোর দু’বছর পর চাচার সুবাধে ঢাকার মিরপুরের একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি হয়। টেলিযোগাযোগ না থাকাতে ঈদের ছুটি ছাড়া বাড়িতে যাওয়া হতো না। অন্য ছুটিতে মাসুদ একাই থাকতেন হোস্টেলে। কারণ ছুটির আগে বাড়িতে চিঠি লিখতে হতো। বাড়িতে থেকে কেউ আসলে যেতে পারতেন। 

এদিকে ২০০৪ সালে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেলে ড্রেনে পড়ে পা ভেঙে যায় মাসুদের। এরপর ২ বছর পড়াশোনা আবার বন্ধ হয়ে যায়। দু’বছর পর ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে এসে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তারপর ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলের একটি স্কুলে ভর্তি হন প্রতিবন্ধীদের সুযোগ সুবিধার কথা শুনে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক বিপরীতটা দেখতে পান। তাই সেখান থেকে গাজীপুরের একটি স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন তিনি।

৮ম শ্রেণীর ফরম ফিলআপ করতে না পেরে পাবনায় চলে যান। প্রতিবন্ধীদের সার্বিক খরচ বহন করবে এমনটা শুনেই সেখানে যাওয়া। ২০১১ সাল থেকে সেখানে পড়াশোনা করেন। তারপর পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে ২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন তিনি।

২০১৪ সালে মাসুদের বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার থেকে আর তেমন কোনো সাপোর্ট পান না। কখনো স্কলারশিপের টাকা দিয়ে, কখনো মানুষের সহযোগিতা চলছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাসুদ। বর্তমানে মাসুদ চবির সোহরাওয়ার্দী হলের সামনের নূর আলম স্টোরের দোকানীর সঙ্গে কথা বলে ক্লাস শেষে একটি টেবিল নিয়ে বসেন। মোবাইলের রিচার্জ, বিকাশ, রকেটে টাকা পাঠানোর কাজ করে দিন শেষে দোকানীর সাথে চুক্তি অনুযায়ী ১০০-১২০ টাকা পান। যা দিয়ে কোনোমতে তিন বেলা হলের খাবারের টাকার ব্যবস্থা হয়। মাসুদের মত এমন প্রতিবন্ধীর সংখ্যা কম নয়। সবার গল্পজুড়েই রয়েছে অনবদ্য সব সংগ্রামের ইতিহাস।

হাজারো প্রতিবন্ধকতার সাথে যুদ্ধ করা প্রতিবন্ধী মাসুদের স্বপ্ন এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়া। মনের জোরে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি এসেছেন। ঠিক সেভাবেই নিজের স্বপ্নকে এখনো মনের মধ্যে লালন করছেন তিনি। তবে আক্ষেপের স্বরেই তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিসিএসের নন ক্যাডারে থাকা ৫% কোটা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত বিশেষ সুবিধা সম্পর্কে আদৌ কিছু জানানো হয়নি। তাই যেই বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা কিভাবে পাওয়া যাবে। পুরো বিষয়টা মন্ত্রণালয় থেকে পরিষ্কার করা না হলে প্রতিবন্ধীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে হয়তো মাঠে নামতে বাধ্য হবে।

তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাহলে কেন প্রতিবন্ধীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে না। তাই স্বপ্ন পূরণে দেশের সর্বচ্চ পর্ষদের নীতিনির্ধারকদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ