জাকারবার্গ: ক্যারিয়ার গড়তে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন যিনি

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কের ফেসবুক অফিস ছাদবাগানের বেধেও চুপচাপ বসে আছেন মার্ক জাকারবার্গ। বড় বড় গাছ, পায়ে হাঁটার। রাস্তা, বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ, খেলার জায়গা আর সবুজ লন মিলে অফিসের ছাদটাকে ছাদ বলে মনেই হয় না। মনে হয় বিশাল এক পার্ক। দিনমান কোডিং নিয়ে ব্যস্ত থাকা প্রকৌশলীরা একটু। তাজা বাতাসের জন্য প্রায়ই ছাদের এই পার্কে এসে ঘুরে যান। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ছাদে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই সম্ভবত নিচে। মহা ব্যস্ত ও উত্তেজিত। ফেসবুকের জন্য আজ একটা বড় দিন। বেশ কয়েক বছরের পরিশ্রম ‘ফেসবুক লাইভ উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে আজ বিশ্বব্যাপী।

২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দ্য ফেসবুক ডটকম নাম দিয়ে অন্তর্জাল বিশ্বে যোগাযোগের যে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন জাকারবার্গ, তাতে আজ যােগ হচ্ছে এই নতুন অস্ত্র । তথ্য প্রদানের একমুখী যে ধারণা—সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ব্যবস্থা সব তিনি ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি করছেন একের পর এক। সামাজিক যোগাযোগের গণ্ডি পেরিয়ে ফেসবুকের যে মানুষটি এত দিন একাই ছিলেন একটি তাৎক্ষণিক তথ্যের আক্ষরিক' প্রচারক, তিনি আজ হতে যাচ্ছেন একটি মিনি টেলিভিশনের মালিক। অর্থহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছেন—গত শতকের বিস্ময়, বাসায় বাসায় শােভা পাওয়া টেলিভিশন সেট আর বিশাল বিশাল অ্যানটেনা বসানো টিভি স্টেশনগুলোর। এসবের মধ্যে জাকারবার্গ ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ। তার দপ্তর আনাগোনা বাড়ছে ভারত, সিঙ্গাপুর সহ নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের। ৩৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে বিশ্বের সম্পদশালীর তালিকায় তিনি এখন ১৬ তম। আরো অনেক আগেই রেকর্ড বুকে নাম। লিখিয়েছিলেন বিশ্বের কনিষ্ঠতম বিলিয়নিয়ার হিসেবে।

গত বছরের মাঝামাঝি নাগাদ নিউইয়র্ক টাইমস-এ জাকারবার্গকে নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। কীভাবে জাকারবার্গ মাইস্পেস, হাই ফাইভ, অরকুটের যুগে সব কিছু পেছনে। ফেলে মানুষের মনের গহীন কোণে যােগাযােগ সমস্যার এক দারুণ সমাধান বাতলে দিতে পারলেন ফেসবুকের মাধ্যমে? নিউইয়র্ক। টাইমসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জাকারবার্গ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অন্তর্মুখী স্বভাবের একজন মানুষ। তিনি জানতেন, মানুষে মানুষে সামনাসামনি যােগাযােগের সমস্যা বা অস্বস্তিগুলাে ঠিক কোথায়। নিজের অভিধতার আলােকে সেই বাধাগুলো দূর করেছেনফেসবুকে । মানুষ একে অপরের সম্পর্কে জানতে চায়, কাকে জানাতে চায়, কার সম্পর্কে জানতে চায়, ঠিক কতটুকু জানতে চায়, সেটাও রাখতে চায় নিজের হাতে। আর এটাই ফেসবুকের সফলতার মূল কারণ।

‘মার্ক প্রচলিত সব নিয়ম ভেঙে সব সম্ভবের  প্রতীক হয়ে উঠেছেন। কোন চমক
যে তিনি ভবিষ্যতের গর্ভে রেখে দিয়েছেন, কে জানে?’

৪৩ হাজার বর্গফুটের ফেসবুক কার্যালয়ের ছাদে সাধারণত এতক্ষণ কখনােই থাকেন না জাকারবার্গ। তবে আজ থাকতে বেশ ভালাে লাগছে । তার গায়ে বরাবরের মতােই ধূসর টি-শার্ট, জিনস। পায়ে কেডস। দিনের আলাে নিভে আসছে দ্রুত। দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের খাড়ির নােনা জল শুকিয়ে ছড়াচ্ছে সাদাটে আভা। জাকারবার্গ কী মনে করে কাঠের বেঞ্চ ছেড়ে পনে গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। কালচে আকাশে ফুটে থাকা তারার ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখ বন্ধ করে নিজেকে দেখতে। পেলেন নিউইয়র্কের ডবস ফেরির নিজের ঘরে।

১৯৯৬ সাল । বয়স তখন সবে ১২ বছর তার। গ্রেড সিক্সে পড়েন। গাফিকাল ইন্টারফেসের কারণে কম্পিউটার তত দিনে এতটা দুর্বোধ্য নয় সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু তিনি দেখলেন কম্পিউটারের প্রাণভােমরা যে প্রোগ্রামিং, সেটি সাদা-কালাের দুর্বোধ্য জগৎ হলেও ভয়াবহ নেশার জগৎ। ঢুকে গেলেন তিনি সেই জগতে। ঘােরের মধ্যে থেকেই আর্টারি বেসিক ভাষা দিয়ে তৈরি করে ফেললেন একটা ইনষ্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস। পরিবারের পদবি অনুযায়ী নাম দিলেন ‘জানেট'। ডেন্টিস্ট বাবা অ্যাডওয়ার্ড জাকারবার্গের চেম্বার ছিল বাসার বাইরের দিকেরই একটা কক্ষ। সেখানে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতেই তাকে দেখালেন নিজের কর্ম। পুত্র-প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ‘জাকনেট' নিজের অফিসে ব্যবহার করবেন। ফলও পেলেন হাতেনাতে। আগে যেখানে নতুন রােগী এলে তার সহকারীকে চিৎকার করে বলতে হতো, সেখানে কম্পিউটারে মেসেজ পাঠিয়েই কাজ সারা গেল। জাক পরিবারেও ব্যবহার শুরু হলাে জাকনেটের।

দেখা গেল, মুখে কোনাে শব্দ উচ্চারণ না করেই বাসার সবাই সবার সঙ্গে কথা বলতে পারছেন জাকনেটের মাধ্যমে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মার্ক তার বন্ধুদের দিয়ে কিছু ছবি আঁকিয়ে নিয়ে তৈরি করলেন একটা ভিডিও গেম। মার্কের স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটির কথা, যেদিন বাবা তার কম্পিউটারপ্রীতি দেখে একজন কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ দিলেন। ডেভিড নিউম্যান ছিল তার নাম। পরে এক রিপোর্টারের কাছে তিনি বলেছিলেন, আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল মার্ককে কম্পিউটার বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া। মার্কের মতাে শিশু-প্রতিভার চেয়ে এগিয়ে থাকা চাট্টিখানি কথা ছিল না। কারণ ওই বয়সেই মার্ক পাশের মার্সি কলেজের কম্পিউটার-বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট কোর্সগুলো ভাজা ভাজা করে ফেলেছিলেন।

এর কিছুদিনের মধ্যেই বালক মার্ক ভর্তি হলেন নিউ হ্যাম্পশায়ারের ফিলিপ এক্সটার নামের এক প্রাইভেট প্রিপারেটরি স্কুলে। স্কুলে মজা
পেয়ে গেলেন ফেন্সিং এর। কিছু দিনের মধ্যে স্কুলের ফেন্সিং দলের প্রধানও হয়ে গেলেন। আরেকটা নেশা চেপে ধরল তাঁকে সে সময়—বই পড়া। স্কুলের পরীক্ষায় সাহিত্যবিষয়ক ডিপ্লোমা পেলেন। এরই মধ্যে তৈরি করে ফেললেন ‘প্যানডােরা’র আগের সংস্করণ ‘সিন্যান্স নামের একটি গান শোনার সফটওয়্যার। সেটি কেনার আগ্রহ দেখাল তখনকার জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান এওএল আর মাইক্রোসফট। তারা মার্ককে চাকরির প্রস্তাব দিল। তখন হাই স্কুলের গণ্ডি পেরোননি। সংগত কারণেই মার্ক সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। 

মার্কের মনে পড়ল, ছােটবেলায় বড় বােন র‌্যান্ডিকে সঙ্গে নিয়ে ‘স্টার ওয়ার্স’-এর প্যারােডি ‘দ্য স্টার ওয়ারস সিল-ওজি'র চিত্রনাট্য তৈরি ও ক্যামেরা নিয়ে শুটিং করার কথা। বাসার সবাইকে নিয়ে খেলা কম্পিউটার গেমসের কথা বা ভুলে যান কিভাবে। সিম সিটি আর মারিও কার্ট গেমের তখন জয়জয়কার। র্যান্ডি, ছােট বােন ডােনা ও অ্যারিয়্যাল—সবাই দিনের একটা বড় অংশ জায়ান্ট স্ক্রিনে সিম সিডির মাধ্যমে নতুন নতুন শহর বানাচ্ছে আর মারিও কার্ট রেসিং গেম খেলছেন। দুটি খেলাতেই বাসার চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি।

২০০২ সালে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মার্ক ভর্তি হলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বছরের মাথাতেই সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে তার ব্যাপক পরিচিতি হয়ে গেল কোর্সমেট নামের একটি প্রোগ্রাম তৈরির সুবাদে। হার্ভার্ডের সংরক্ষিত ডাটাবেজ হ্যাক করে। বানালেন ফেসম্যাশ নামের একটি প্রোগ্রাম। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীর ছবি পাশাপাশি দিয়ে কে বেশি আকর্ষণীয়, তার ভােটাভুটির ব্যবস্থা করলেন। সাড়া পড়ে গেল দারুণ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুতই বন্ধ করে দিল এই প্রোগ্রাম। কম্পিউটার হ্যাক করার অপরাধে ছাত্রত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ল। ক্যাম্পাসের আলােচিত মুখ হয়ে উঠলেন মার্ক।

‘জাকারবার্গের পরিকল্পনায় এখন বড় বাধা রাজনীতিবিদেরা। ফেসবুকের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার অনেকেই। ফেসবুককে ভেঙে ফেলার আওয়াজ উঠছে। জাকারবার্গ চাইছেন, সরকারিভাবে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের মতো নিয়ম করা হোক, যাতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো তার আওতার মধ্যে থেকে কার্যক্রম চালাতে পারে।’

সেই সুবাদে হার্ভার্ডের তিন শিক্ষার্থী দিভ্যা নরেন্দ্র, যমজ ভাই ক্যামেরন ও টাইলার উইনক্লভস একদিন মার্ককে ডেকে বললেন, তারা হার্ভার্ড কানেকশন নামে একটি সামাজিক যোগাযোগের সাইট তৈরি করতে চান। সেখানে তিনি প্রোগ্রামার হিসেবে কোড লিখবেন কি না। মার্ক রাজি হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই নিজেকে সেই প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করে বন্ধু ডাস্টিন মস্কো ভিচ, ক্রিস হিউজ এবং এদুয়ার্দো সাভেরিনকে নিয়ে শুরু করলেন নিজের সামাজিক যােগাযােগ সাইট— দ্য ফেসবুক ডটকম। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে চলে এলেন আমেরিকার পূর্ব উপকূল থেকে একেবারে পশ্চিম উপকূলে, ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির পালো অ্যালটো শহরে। ড্রপআউট হলেন হার্ভার্ড থেকে। মার্কের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। তৈরি হতে শুরু করল ইতিহাস। পাল্টে যেতে থাকল মানুষে মানুষে যোগাযোগের ধারণা। তৈরি হলো সম্পর্কের নতুন ভিত। সেটার কারিগর হিসেবে ২০১০ এবং ২০১৩ সালে মার্ক নির্বাচিত হলেন টাইম পারসন অব দ্য ইয়ার' হিসেবে।

ফেসবুকের ছাদবাগানে বাস্তবে ফিরে এলেন মার্ক আশপাশের কর্মীদের উল্লাসধ্বনিতে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ বিপুল উৎসাহে লাইভে আসা শুরু করেছে নানাধর্মী বিষয় নিয়ে। কেউ ঘটমান কোনে খবর, কেউ লাইভ খেলাধুলা, কেউ দিচ্ছে কোনে কোনাে বিষয়ে নিজের বিশ্লেষণী মতামত। ফেসবুক ফিডে লাইভের ‘রিচ বাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে মার্ক যুক্ত হলেন তার ইঞ্জিনিয়ারদের পার্টিতে।।

এর কয়েক দিনের মধ্যেই ফোর্বস ম্যাগাজিনে যারা স্টোন নামের একজন প্রকাশ করলেন একটি নিবন্ধ—মার্ক জাকারবার্গ কি হতে পারেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট? তাতে তিনি লিখলেন, আমেরিকার কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট হওয়ার রেকর্ড তৈরি করেছিলেন থিওডোর রুজভেল্ট, ৪২ বছর বয়সে। ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে মার্কের বয়স হবে ৪০ বছর। মাত্র দুই বছর কম রুজভেল্ট থেকে। কাজেই বয়সের দিক থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া কোনো সমস্যা নয়। অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের চেয়ে শুরু থেকেই মার্কের। রাজনৈতিক যােগাযােগ অনেক বেশি। অন্যদিকে মার্কের রয়েছে বিশাল ফ্যানবেস। সেবামূলক কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন মার্ক তার চ্যান-জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে। আর বাকি থাকে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য অর্থ। এই মুহূর্তে মার্ক বিশ্বের ষষ্ঠতম ধনী লােক। তাহলে জাকারবার্গের প্রেসিডেন্ট হতে বাধা কোথায়? 

নাকি তার লক্ষ্য আরও বড়? পৃথিবীর মানুষের একটা বড় অংশ এখনো রয়ে গেছে যোগাযোগের বাইরে। তাদের একই সুতোয় বাঁধার জন্য মার্ক তৈরি করেছেন ইন্টারনেট ডট অর্গ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রতিটি বিন্দুতে ইন্টারনেটের আলো পৌছে দেওয়ার কাজ করছে, মতান্তরে তার ফেসবুক নেটওয়ার্কের আওতায় আনার চেষ্টা করছেন। এতে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের ওপর। তার নিয়ন্ত্রণ হবে আরও গভীর ও ব্যাপক। তাহলে তাকে রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে থেকেই মার্ক তৈরি করতে পারবেন আরও শক্তিশালী কোনাে ব্যবস্থা। হয়ে উঠবেন এক কেন্দ্রীয় বিশ্বনিয়ন্তা। খুবই অসম্ভব শোনাচ্ছে। কিন্তু মার্ক প্রচলিত সব নিয়ম ভেঙে সব সম্ভবের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। কোন চমক যে তিনি ভবিষ্যতের গর্ভে রেখে দিয়েছেন, কে জানে?

[সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত ‘ভালোবাসার তারুণ্য- পৃথিবীর পাল্টে দেওয়া তরুণেরা’ বই থেকে]


সর্বশেষ সংবাদ