ভাইভা পাসে আয়নার সামনে দাঁড়ান, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শিখুন

মো. আল আমিন
মো. আল আমিন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আল আমিন । তিনি ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় সমবায় ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করে সম্প্রতি যোগদান করেছেন। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র হয়ে এম এম মুজাহিদ উদ্দীন তার সাথে ভাইভা অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ নিয়ে আলাপ করেছেন।

‘ভাইভা’ মোটামুটি সবার কাছেই আতঙ্কের নাম। সম্ভবত এ কারণেই অনেকে বলে থাকেন- ভাইভা নেয়ার কি দরকার; প্রিলিমিনারি এবং রিটেনের মার্কস যোগ করে দিলেই হয়। সত্যি বলতে কী, রাষ্ট্রের সিদ্বান্ত গ্রহণের জন্য আপনি কতটা যোগ্য; এটার একটা নমুনা হল ভাইভা। আমার কাছেও এটি আতঙ্ক ছিল।কিন্তু একটা সময় এ ভয়টা কাটাতে উঠে পরে লাগলাম। ভাইভাকে আমার কাছে একটা ফুটবল গেম হিসেবে মনে হয়।

ধরুন, আপনি গোলকিপার হিসেবে আছেন। পেনাল্টি শর্ট হবে। ঠেকাতে পারলে আপনি জয়ী, আর না পারলে পরাজয়। এক্ষেত্রে ভাগ্য কিন্তু সহায় হতে হবে। আপনার প্রস্তুতি যত ভাল হবে, কনফিডেন্ট তত বেশি থাকবে, ভাগ্য আপনাকে সাপোর্ট দেবে।

আমি ৩৬তম এবং ৩৭তম উভয় ভাইভাতে অংশগ্রহণ করি। আগে কয়েকটি ব্যাংক ভাইভা দেয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। যখন ৩৬-এর ভাইভা দিতে গেলাম, আমার কাছে তখন মনে হল ব্যাংক এবং বিসিএস দুটোর ভাইভা মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। তাই ৩৬তম-তে খালি হাতে ফিরলাম। টার্গেট করলাম ৩৭তম। ব্যাংকে জব হয়েছে কিন্তু করিনি। লক্ষ্য বিসিএস। নিজেকে নতুন করে প্রস্তুত করলাম।গণিতের ছাত্র হওয়ায় আমি ইংরেজিতে দুর্বল ছিলাম। প্রতিদিন কিছু সময় ইংরেজিতে কথা বলা প্রাকটিস করতাম। একটা সময় সবকিছু সহজ হয়ে এলো।

নিজেকে প্রস্তুত করতে প্রথমে আমি আমার দুর্বল দিকগুলো বাছাই করলাম। এর মধ্যে একটি হল কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা। আপনি ট্রাই করে দেখতে পারেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে কোন বিষয়ে ২ মিনিট বলতে পারেন কিনা? যদি পারেন, তাহলে আপনি আমার থেকে একধাপ এগিয়ে আছেন। আমি পারতাম না, তাই প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতাম এবং উত্তর দিতাম। আপনি যখন আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে অনর্গল কথা বলতে পারবেন, বুঝে নিবেন আপনি ভয়কে জয় করেছেন। এটাকে খুব কার্যকরী মনে হয় আমার। নিজ বিষয়ের বেসিক খুব ভাল করে প্রস্তুতি নিলাম। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, সাম্প্রতিক বিষয় এবং পছন্দক্রমের প্রথম দুটি সম্পর্কে বিস্তারিত প্রস্তুতি নিলাম।

আমার বিসিএস ভাইভা
ভাইভার দিন নিজেকে খুব স্থির রাখার চেষ্টা করলাম। বোর্ডে গিয়ে দেখি আমার সিরিয়াল ১৫ জনের মধ্যে ১১ নম্বরে। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে আমার ভাইভা শুরু হল। সালাম দিয়ে প্রবেশ করে অনুমতি নিয়ে বসলাম। একটা বিষয় মনে রাখবেন, ভাইভা বোর্ড কখনোই আগে থেকে প্রশ্ন লিখে রাখে না। আপনি যে উত্তর দেবেন, সেটার আলোকেই প্রশ্ন হবে। আর বোর্ডকে ইম্প্রেশ করতে হবে। কষ্ট হলেও মুখে হাসি ভাব রাখার চেষ্টা করেছি। বোর্ড এটাই দেখে- আপনি কতটা সাবলীল।

ভাইভা বোর্ড আমার জেলা দিয়ে শুরু করলেন, জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। জেলার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তরগুলো এমনভাবে করছিলাম যাতে করে পরবর্তী প্রশ্ন আমার উত্তর থেকেই হয়। এটা যদি আপনি করতে পারেন, তবে খুব ভালো হয়। বোর্ড মুক্তিযুদ্ধে ঢুকেছে দেখে আমিও চেষ্টা করছি ওই দিকে রাখার জন্য। হঠাৎ আমার পছন্দক্রম জানতে চাইলেন। আমি বললাম।

বোর্ড যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে জানতে চাইলো। আমার জেলাতে একজন যুদ্ধাপরাধী আছে, তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। অন্যদের গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ জানতে চাইল, বিস্তারিত বললাম। ঐসময় ৭মার্চ ভাষণ World documentary heritage-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলো। ৭ মার্চের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট কী, ৭ মার্চের ভাষণের আগে এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপট এবং বঙ্গবন্ধুর মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরনার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলো।এ ভাষণ লিখিত কিনা, আমি বললাম অলিখিত, একজন মেম্বার জোর দিয়ে বলল লিখিত কিন্তু আমি আমার উত্তরে অনড়। আসলে এখনে আমার mental strength দেখছিল। আমি সব প্রশ্ন সাবলীলভাবে উত্তর দিয়েছি এবং খেয়াল করেছি- আমার উত্তর শুনে তারা হাসছে এবং সম্মতিসূচক মাথা নাড়াচ্ছে।

আমার কন্ঠ একটু মোটা এবং গম্ভীর হওয়ায় আমাকে বলা হল ৭মার্চের ভাষণ বলতে। কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুর কন্ঠ নকল করতে পারবো না। আমি ভাষণ বললাম। বোর্ডের মেম্বাররা হেসে দিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন ছিল, বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেক। ১৪ ডিসেম্বর এর ঘটনা এবং এর মূল নায়ক কে ছিল?

এক মেম্বার জিজ্ঞাসা করলো, ‘৭ মার্চ ভাষণে যে মুক্তির কথা বলা হয়েছে, সেই মুক্তি কি হয়েছে?’ আমি উত্তর করলাম। এরপর আমার প্রথম চয়েজ নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন করলো। আমি আল্লাহর রহমতে একটা প্রশ্নে স্যরি বলেছি বাকি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।

এছাড়া আমার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন ছিল। বোর্ড যখন আমাকে বিদায় দিল। উঠে সালাম দিয়ে দরজায় আসার পরে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, তারা হাসছে। বুঝলাম, তাদের কিছুটা হলেও সন্তুষ্টি অর্জন করেছি। মোট ১৭ মিনিটের মত ভাইভা দিয়েছি।

বোর্ড সব সময় দেখে আপনি কতটা সুস্থিরভাবে উত্তর করছেন। আপনি সব উত্তর জানবেন, এমনটা বোর্ড কখনোই আশা করে না। তবে আপনার ‘স্যরি’ বলার মাঝেও স্থিরতা আছে কি-না, এটাই যাচাই করে। আপনি কখনোই পারফেক্ট হবেন না, বোর্ড চায় আপনার মধ্যে যেন পারফেক্ট হওয়ার মতো ক্যাপাবিলিটি থাকে।

একটা কথা বলেছিলাম শুরুতেই। ভাগ্য নিয়ে। আমি প্রতিটা বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা নিয়ে গিয়ছিলাম, তাই ভাগ্য আমাকে বিমুখ করেনি। আপনি চেষ্টা করলে ভাগ্য আপনাকে সমর্থন করবেই। তবে হ্যা প্রস্তুতির যেন কোন ঘাটতি না থাকে।

সাক্ষাৎকারদাতা সম্পর্কে আরো জানতে:মঞ্চ নাট্য অভিনেতা যখন সফল বিসিএস ক্যাডার

সারকথা
ভাইভা কোন ভয়ের বিষয় না। আপনি মনে করেন আপনি নতুন কারো সাথে গল্প করতে আসছেন। এতে করে কিছুটা চাপ কমবে। আমি বোর্ডে ঢোকার সময় মাথায় নিয়েছি যে বাড়িতে নতুন মেহমানদের সাথে কার্টেসি বজায় রেখে কথা বলতে এসেছি। এটাই বোর্ডের সামনে আমার হাসিটাকে ফুটিয়ে তুলেছে। তবে একটি কথা না বললেই নয়, আমার এক স্যার, যিনি আনছার ক্যাডার। তিনি আমাকে বলেছিল, ‘তুমি যে মৃদু একটা হাসি দাও, এটা বোর্ডে ঢোকার সাথে সাথেই দিবা, কাজ হবে’। স্যারকে ধন্যবাদ এ লুকানো গুণটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য।

বাবা মা এর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমি আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া জানাই।

পড়ুন: ভাইভা বোর্ড হলো অভিনয় মঞ্চ, ‘নার্ভাস’ বুঝতে না দেওয়াই কৌশল

পড়ুন: জীবনের গল্প: বাবার সম্মান রক্ষায় এএসপি দিদার নূর


সর্বশেষ সংবাদ