ক্যাডার হয়েই ‘মোটিভেশনাল স্পিকার, ‘কী পেলাম, কী পাব’ নিয়ে চিন্তা!

বিসিএসে টেকার পরপরই আমরা প্রথমেই ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হয়ে যাই। জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে ছেলে-মেয়েদের মোটিভেশন দিতে শুরু টাকার বিনিময়ে। সবাইকে বিসিএস ক্যাডার বানিয়ে ফেলি মুখের কথাতেই।

হ্যাঁ, একসময় আমিও তা করেছি। যোগদান করার পরে হিসাব কষা শুরু করি কোন সার্ভিস কি পাচ্ছে, আমি কি পাচ্ছি, ডেপুটেশনে কার ঘাড়ের উপর যাওয়া যায়, অন্য সার্ভিসের পেছনে কীভাবে লাগা যায়, আমার ক্ষমতা অমুকের চেয়ে বেশি সেটা কিভাবে দেখানো যায়, অমুক সার্ভিসের লোক আমার মুখের উপর কিভাবে কথা বলে, অমুক আমার সিনিয়র হলেও অন্য সার্ভিসের হওয়াই তাকে কীভাবে স্যার ডাকবো ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথমে নিজেদের ভেতরে পলিটিক্স, পরে সেটা বাইরের সার্ভিসের কাউকে বুঝতে না দিতে বাইরের সার্ভিসের লোকেদের সাথে পলিটিক্স। মাইলের পর মেইল রোদের ভেতর হেঁটে নিজের বা পরিবারের কাজ করে বেড়িয়েছি। আজ সরকারি গাড়ি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে কাজই করতে পারি না। আবার গাড়িটা এসি না হলে তো কথাই নেই। আমরা সবাই খুব ধনী পরিবার থেকে এসেছি তো! জন্ম থেকেই আমাদের ধনী দিন-মজুর বা ধনী কৃষক বাবা এসির বাতাস খাওয়াতে খাওয়াতে বড় করেছেন। তাই এসি ছাড়া এখন চলেই না।

আবার অমুক ক্যাডার সফলতা স্বরূপ গাড়ি পেলো আমার ক্যাডার এতো কিছু করলো; আমারটা কই? এরকম ওচা মার্কা ক্যাডারকে এতো দামি গাড়ি দিতে হলো? অথচ তার কাজ-কর্তব্যের পরিসর দেখেও না দেখার ভান করি; আর তার কাজের সুফল কতখানি তা হিসাব না করে তার দায়িত্বকে ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ কতখানি সেটা দেখেই বিবেচনা করি সেটা উচ্চ না ওচা মার্কা ক্যাডার?

অমুকে অন্যায় করেছে তো কি হয়েছে সে আমার সার্ভিসের! সবাই তাকে রক্ষা করার জন্য জেগে ওঠো। তাকে ফেরেশতার চরিত্র প্রদান করে গল্প লিখে দ্রুত ফেসবুকে পোস্ট করো। এমন একটা ভাব ধরবো যেনো আমাদের সার্ভিসে কেউই বাপজন্মে দুর্নীতি শব্দটাই শোনেনি, সম্পূর্ণ ফেরেশতাদের দিয়ে সার্ভিসটি পরিচালিত। অমুকের কতো বড় সাহস সে আমাকে স্যার ডাকলো না! আবার, অমুক সার্ভিসের ওকে স্যার ডাকতে হবে কেন? ওরা ‘স্যার’ ডাক শোনার উপযুক্ত!

অন্য সার্ভিসের কোন একটা মন্দ খবর পত্রিকায় ছাপা হলে খুশির ধকল সামলে নিতেই কষ্ট হয়। কারো বিপক্ষে একটা লেখা এলে সত্য-মিথ্যা যাই হোক আমি নিজে তাকে খাটো করতে ছাড়ি না। কারণ, সে তো আমার সার্ভিসের নয়।

দেশপ্রেমটা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। কী পেলাম, কী পেলাম না, অমুকে কতোখানি বেশি পেল; এগুলো নিয়েই দিনের ৪ ভাগ সময়ের দুই ভাগ ব্যয় করি। যে দায়িত্ব পালনের জন্য যোগদান করেছেন; কখনো কি ভেবেছেন সেই দায়িত্ব নিয়ে? কোনদিন নির্জনে বসে ভেবেছিলেন সাধারণ মানুষ বা দেশের জন্য আপনার ব্যক্তিগত অবদান কতটুকু?। আপনি ব্যক্তি হিসেবে কতখানি করলেন দেশের জন্য? আপনার সততা ধরে রাখতে পেরেছেন তো, না-কি স্রোতে গা ভাসিয়ে তথাকথিত সৎ হয়ে উঠেছেন?

আমরা বিসিএসের রেজাল্টের আগেই দেশ নিয়ে যা ভাবার ভাবি। এরপর ভাবি কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে, মোটিভেশনাল স্পিস দিয়ে টাকা কামানো নিয়ে। জয়েন করে ভাবা শুরু করি কী পেলাম, কী পাব, কার থেকে কম পেলাম, কার থেকে বেশি সম্মান, বেশি ক্ষমতা পেলাম তা নিয়ে। দেশ, মাটি, মানুষ নিয়ে ভাববার সময় কোথায়? আমি কত্ত বড় অফিসার এসব হাবিজাবি নিয়ে আমার ভাবলে চলে?

ছোট মুখে একটা বড় কথা বলবো, ‘আপনি যদি ভালো অফিসার হওয়ার আগে ভালো মানুষ হতেন তাহলে দেশের অবস্থা অনেক আগেই বদলে যেত। কখনো ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেছেন, আপনি কি মানুষ হয়েছেন নাকি শুধুই একজন অফিসার হয়েছেন, একজন মানবতাবিহীন ভালো সরকারি অফিসার? ভেবেছেন কখনো আপনার দায়িত্ব কত বেশি যে, আপনি বদলালে দেশটার চেহারাই বদলে যাবে?’

লেখক: ওয়ালিদ ইসলাম, ৩৫ তম বিসিএস (পররাষ্ট্র)।


সর্বশেষ সংবাদ