৩০০ বছরের পুরোনো নোয়াখালীর বিখ্যাত ‘বজরা শাহী মসজিদ’

নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ
নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ  © টিডিসি ফটো

নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ ১৮শ’ শতাব্দীতে নির্মিত। এটি জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলাধীন বজরা ইউনিয়নের অবস্থিত একটি মসজিদ। নোয়াখালীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলির একটি মসজিদটি। ২৯ নভেম্বর ১৯৯৮ থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বজরা শাহী মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে।

মোঘল আমলের যেসব স্থাপত্য শিল্প সবার নজর কাড়ে, নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণ করা হয় দিল্লি শাহী মসজিদের আদলে। মসজিদটি নোয়াখালীর বৃহত্তম শিল্পনগরী চৌমুহনী চৌরাস্তা থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে বজরা নামক গ্রামে অবস্থিত।

মসজিদটির চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, প্রবেশ করার পথটি পূর্ব দিকে। মসজিদটি দিঘীর পশ্চিম পার্শ্বে উঁচু ভিত্তির ওপর নির্মিত। বজরা শাহী মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর কারণে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বজরায় আসেন নামাজ পড়তে এবং এর সৌন্দর্য্য দেখার জন্য।

বজরা শাহী মসজিদের অবস্থান মসজিদটি আয়তাকার (১৬ মি.×৭.৩২ মি.), মসজিদটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা। বাইরের চার কোণায় অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। মসজিদের পূর্বে তিনটি, উত্তরে ও দক্ষিণে একটি করে মোট পাঁচটি দরজা রয়েছে। দরজা বাইরের দিকে অভিক্ষিপ্ত এবং দজার উভয় পার্শ্বে সরু মিনার রয়েছে।

পূর্বদিকের তিনটি দরজা বরাবরে কিবলা দেয়াল রয়েছে, যার অভ্যন্তরে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মাঝের মিহরাবটি অন্য দু’টির থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। মসজিদের অভ্যন্তরীণ দুটি কক্ষ আছে, যা বহুখাঁজবিশিষ্ট আড়াআড়ি খিলান দ্বারা তিন ভাগে বিভক্ত।

ছাদের উপর তিনটি কন্দাকৃতির গম্বুজ আছে যা অষ্টকোণাকার। এগুলির শীর্ষ পদ্ম ও কলস চূড়া দ্বারা সজ্জিত। বজরা শাহী মসজিদের ইতিহাস মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের রাজত্বকালে ১৭৪১-৪২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি আমান উল্লাহ কর্তৃক নির্মিত হয়। ১৯১১ থেকে ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে বজরা জমিদার খান বাহাদুর আলী আহমদ ও খান বাহাদুর মুজির উদ্দিন আহমদ মসজিদটি ব্যাপকভাবে মেরামত করেছিলেন এবং সিরামিকের মোজাইক দিয়ে সজ্জিত করেছিলেন।

দিল্লির মোঘল সম্রাটগণ ভারতবর্ষে ৩০০ বছরের অধিকার রাজত্ব করেন। এ দীর্ঘ সময়কালে মোঘল সম্রাটগণ এবং তাদের আমলারা বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ইমারত, মসজিদ নির্মাণ করেন যা আজও স্থাপত্য শিল্পের বিরল ও উজ্জ্বল নির্দশন হিসেবে বিরাজমান। এগুলোর মধ্যে আগ্রার তাজমহল, সেকেন্দ্রা, দেওয়ানে আম, আগ্রার দূর্গ, দিল্লির লাল কেল্লা ও দিল্লির শাহী জামে মসজিদ অন্যতম।

মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের আমলে দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদের অনুকরণে জমিদার আমান উল্যাহ ১১৫৪ হিজরিসাল, ১১৩৯ বাংলা মোতাবেক ১৭৪১ সালে অর্থাৎ প্রায় তিনশত বছর পূর্বে বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজও মোগল স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে।

জমিদার আমান উল্যাহ তার বাড়ির সম্মুখে ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পাড় যুক্ত একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। এ দিঘীর পশ্চিম পাড়ে মনোরম পরিবেশে আকর্ষণীয় তোরণ বিশিষ্ট প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ২০ ফুট উঁচু তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এ ঐতিহাসিক মসজিদখানা নির্মাণ করেন।

এ মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে ভিত তৈরি করা হয়। সুদৃশ্য মার্বেল পাথর দ্বারা গম্বুজগুলো সুশোভিত করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি ধনুকাকৃতি দরজা। মসজিদের প্রবেশপথের উপর রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ।

কেবলা দেওয়ালে তিনটি কারুকার্য খচিত মিহরাব আছে। বংশানুক্রমিক ইমাম মোঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের বিশেষ অনুরোধে পবিত্র মক্কা শরীফের বাসিন্দা, কারো মতে দিল্লির বাসিন্দা তৎকালীন অন্যতম বুজুর্গ আলেম হযরত মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিকী এ ঐতিহাসিক মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে নিয়োজিত হন।

তার বংশধরগণ যোগ্যতা অনুসারে আজও এ মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে প্রথম ইমামের সপ্তম পুরুষ ইমাম হাসান সিদ্দিকী উক্ত মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। মহিলারাও নামাজ পড়েন মসজিদে।

বজরা শাহী মসজিদে বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে নামাজ আদায় করেন। গত ১০ বছর ধরে মহিলারও নামাজ পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন এ মসজিদে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯৮ সালে ২৯ নভেম্বর সরকারি গেজেটে মসজিদটিকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

ফলে মোঘল স্থাপত্যকলায় নির্মিত এই মসজিদটির সৌন্দর্য্য অম্লান হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। তবে এলাকাবাসী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান - মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নতুন করে সিরামিক স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে পুরো মসজিদকে আনা হয়েছে সিসি ক্যামেরার আওতায়। সরকার সময় উপযোগী উদ্যোগ নিলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হবে বজরা শাহী মসজিদ।

যেভাবে যেতে পারেন: ঢাকা থেকে সরাসরি সোনাইমুড়ী যেতে পারেন অথবা নোয়াখালী জেলা সদর মাইজদী হতে সোনাইমুড়ীর যেকোনো লোকাল বাস সার্ভিস, সিএনজি অথবা অটোরিকশাযোগে বজরা হাসপাতালের সামনে নেমে রিকশা বা পায়ে হেঁটে ২০০ গজ পশ্চিমে গেলে বজরা শাহী মসজিদে পৌঁছানো যাবে।


সর্বশেষ সংবাদ