দক্ষিণবঙ্গের অপার বিস্ময় ভাসমান পেয়ারা বাজার

ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। বরিশালের বিচিত্র ভূপ্রকৃতি যে কোন ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করে থাকে। যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল থেকে একটু সতেজ নিঃশ্বাস ফেলতে বরিশালের মত জায়গা দেশের আর কোথাও নেই।বরিশালের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অন্যান্য মাত্রা যোগ করেছে ভাসমান পেয়ারা বাজার। বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুর জেলার ত্রিমোহনায় গড়ে উঠেছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম ভাসমান পেয়ারা বাজারটি। এই অঞ্চলের ২৬ গ্রামের প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর গড়ে ওঠেছে পেয়ারা বাগানগুলো। আর এ পেয়ারা চাষের সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার পরিবার সরাসরি জড়িত।

ভীমরুলি, কুরিয়ানা ও আটঘর বিখ্যাত ভাসমান পেয়ারা বাজারের জন্য বিখ্যাত। আটঘর থেকে ডিঙ্গি নৌকা বা ট্রলারে উঠলেই মনে হবে এক অদ্ভূদ রূপের জগতে প্রবেশ করছেন। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। যেন সবুজ রূপকথার রাজ্য।দৃষ্টিপথে ধরা দেবে হোগলা, সুপারি, আমড়া আর পেয়ারা বাগানের অপরূপ দৃশ্য। নৌকা যতই সামনে এগুবে খাল ততই সরু হবে। খালে চলতি পথে দেখতে পাবেন গাছ থেকে পেয়ারা নামানোর দৃশ্য। চাইলে হাত বাড়িয়ে আমরা কিংবা পেয়ারা ধরতে পারবেন। আর যদি বৃষ্টি হয় তবে চারপাশটা আরো অপার্থিব সৌন্দর্য্যে মোহনীয় হয়ে উঠে। দেখা যায় লাইনকে লাইন ডিঙ্গি নাও বোঝাই করে পেয়ারা নিয়ে বাজারে নিয়ে আসার দৃশ্য। সব পূর্ণতা ভিমরুলি এসে।সারিসারি ভাসমান নৌকায় সবুজ হলুদ পেয়ারার ছড়াছড়ি। ক্রেতাবিক্রেতার হাঁকডাকে মুখরিত জায়গাটি এক বিস্ময় বটে।

আকর্ষণীয় দিক হল, ভাসমান বাজারের উত্তর প্রান্তে খালের উপরের থাকা ছোট একটি সেতু। সেখান থেকে বাজারটি খুব ভালো করে দেখা যায়। এখানে আসা সব নৌকাগুলোর আকার আর ডিজাইন প্রায় একই রকম। মনে হবে যেন, একই কারিগরের তৈরি সব নৌকা।

মাত্র ৩০/৪০ টাকা মূল্যের টিকিট কিনে ঢুকতে পারেন শতবর্ষী পেয়ারা বাগানগুলোতে। ইচ্ছা মত পেয়ারা পেরে খেতে পারেন।কিন্তু ব্যাগ ভরে আনতে পারবেন না। ওয়াসটাওয়ারের উপরে উঠে পেয়ারা বাগানের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। নিরিবিলি বসে আড্ডা, খোশ গল্প করার মতোও অপরূপ জায়গা পেয়ারা বাগানগুলো।

সন্ধ্যের আধাঁরীতে খালের মাঝে বয়ে চলা দিবে গা শিরশিরে অনুভূতি। অস্পষ্ট পথ ধরে দক্ষ মাঝির বয়ে চলা। আকাশে ততক্ষনে তারাদের মেলা বসেছে। মেঘের আড়ালে ক্ষনিক পর পর উঁকি দিচ্ছে সপ্তর্ষি। ট্রলারের ছাদে শুয়ে সেই আকাশ দেখতে দেখতে বাঁচতে ইচ্ছে হবে আরো বহু বছর।

ভীমরুলি বাজার ছোট হলেও দুপুরে তার একরূপ, সন্ধ্যেতে আরেক রূপ। বাজারের ঋতুপর্ণা দোকানের রসগোল্লা না খেলে হবে চরম মিস। গরম গরম মিষ্টিরই স্বাদ যেন অমৃত। দুপুরে খেতে হবে বৌদির হোটেলে। সে আরেক অমৃত সুধা। ডিঙ্গি নৌকায় বসে খালের সাথে লাগোয়া ঘরবাড়ি, স্কুল, ব্রিজ এবং রাস্তার সম্মোহনী রুপ উপভোগ করতে পারেন।


শত বছরের পুরনো এই হাটের আশেপাশে আছে দুইশত বছরের পুরনো পেয়ারা বাগান। যেসব বাগান থেকে উৎপাদন হয়ে লক্ষাধিক মণ পেয়ারা।এক সময় দাম না পেয়ে এই হাটে চাষীরা পেয়ারার নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে খালি নৌকা নিয়ে ফিরে যেতো। কিন্তু সম্প্রতি যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এই বাজারের জৌলুস বাড়তে শুরু করেছে।

এখানে প্রতিদিন পেয়ারা বোঝাই শত শত নৌকা নিয়ে বিক্রেতারা খুঁজে বেড়ায় ক্রেতা। আর ক্রেতাদের বেশিরভাগই হল পাইকার। স্থানীয় ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, নোয়াখালী থেকে আসা বেপারীরা নৌকা থেকেই পেয়ারা কিনে ট্রলার অথবা ট্রাকে করে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যান।সকালের দিকে পেয়ারা বিক্রি হয় ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা মণ দরে। এই অঞ্চলে প্রধানত মুকুন্দপুরী, লতা ও পুর্নমণ্ডল জাতের পেয়ারা উৎপাদন হয়। এই পেয়ারা খেতে মিষ্টি ও অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।

কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনের একঘেয়েমিতার কোন শেষ নেই। ঈদের এই ছুটিকে কাজে লাগিয়ে নিজের একঘেয়েমিতা দূর করতে অবারিত সবুজের মধ্যে একটুখানি প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে আপনিও বের হতে পারেন চেনা গণ্ডি ছেড়ে নতুনের পথে, নতুন কোন জায়গায়। তাই আপনি ও ঘুরে আসতে পারেন এমন একটি জায়গা থেকে। প্রকৃতির নিবিড় ঘনিষ্ঠতা, জলে নৌকায় ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম ভাসমান পেয়ারা বাজার থেকে।

যেভাবে যাবেন: বাংলাদেশের সবথেকে আরামদায়ক যাত্রা সম্ভাবত দক্ষিণ অঞ্চলেই। যানজটে পরে অপার্থিব কষ্টের কোন ঝনঝর্টা নেই এ অঞ্চলে যাত্রা পথে। স্থলজ,নৌপথ ,আকাশ তিন পথেই আপনি আসতে পারেন বরিশালে।

১. নৌপথে ঢাকা-বরিশাল-স্বরূপকাঠি-ঢাকা: সদরঘাট থেকে প্রতিদিন রাত ৯ টায় বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায় অনেকগুলো বিলাসবহুল লঞ্চ। কোনো একটা পূর্ণিমার রাতে উঠে পড়লে বোনাস হিসেবে পাবেন মনোরম জ্যোৎস্না বিলাস। এর জন্য আপনাকে ভাড়া গুনতে হবে ভিআইপি কেবিনের জন্য ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা, সেমি ভিআইপি কেবিন ৪০০০ থেকে ৪৫০০ টাকা, ফ্যামিলি কেবিন ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা এবং ডেকে জনপ্রতি ২৫৫ টাকা।

আপনাকে সকাল ৭টায় বরিশাল নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে নাশতা করে লেগুনা ঠিক করে ফেলুন স্বরূপকাঠি যাওয়ার জন্য। এক লেগুনায় ১৪ জন যাওয়া যায়। রিজার্ভ ভাড়া পড়বে ৪০০-৫০০ টাকা। ছোট গ্রুপ সিএনজি টাইপ টেম্পো ভাড়া করে নিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে। এরপর ১টা ৩০ মিনিট জার্নির পর পৌঁছে যাবেন স্বরূপকাঠি। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে নিন সারা দিনের জন্য। ভাড়া পড়বে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা। আকারভেদে প্রতিটি নৌকায় ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ ধরে। কিছু ছোট নৌকাও পাওয়া যায় তবে খুব কম।

স্থলপথ: ঢাকার গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহনের এসি বাসও যায় বরিশাল। ভাড়া ৮০০ টাকা। এ ছাড়া ‘হানিফ’, ‘ঈগল’, ‘সুরভী’ ও ‘সাকুরা’ পরিবহনের নন-এসি বাসও যায়, ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য রয়েছে ‘সুগন্ধা’ পরিবহনের বাস।