অক্সফোর্ডে খুন ও ক্যাম্পাস পালানো পণ্ডিতদের হাতে ক্যামব্রিজ প্রতিষ্ঠার গল্প

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শোনেনি এমন লোক খুব কম আছেন। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ শহরে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ইংরেজিভাষী বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে) এবং সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি হিসেবে পরিচিত।

সালটা ১২০৯। এ বছরই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন পণ্ডিতের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় ক্যামব্রিজের। লন্ডন থেকে মাত্র ৬২ মাইল দূরে অবস্থিত ক্যামব্রিজ শহর। এ শহরের প্রতিটি পরতে যেন শিক্ষা ও ঐতিহ্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। ক্যামব্রিজ যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন পুরো ইংল্যান্ডের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ডের পণ্ডিতদের সঙ্গে স্থানীয় লোকদের বিবাদ লেগেই থাকত। এমন বিবাদপূর্ণ প্রেক্ষাপটেই এক নারীর খুনকে কেন্দ্র করে অক্সফোর্ডের তিনজন শিক্ষার্থীকে শহর কর্তৃপক্ষ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। পরিস্থিতি চলে যায় আরও অবনতির দিকে। এ সময় শিক্ষার্থীরা দলে দলে অক্সফোর্ড ছেড়ে নিকটবর্তী রিডিং এবং ক্যামব্রিজ শহরে চলে যায়। অনেকে প্যারিসও চলে যান। আবার কেউ কেউ ক্যামব্রিজ শহরেও জড়ো হতে থাকেন।

মূলত এ সময়ই তাদের মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার করার মতো প্রয়োজনীয় স্কলার ক্যামব্রিজ শহরে ইতোমধ্যেই আছেন। সেটাকে ভিত্তি ধরেই প্রথমে সংগঠন গড়ে তোলেন এবং পরবর্তীতে অক্সেফোর্ডের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সবাই মিলে ক্যামব্রিজ শহরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন; নাম দেয়া হলো— University of Cambridge বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। যা পরে ইংরেজিভাষী বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

১৩’শ শতাব্দীতে ক্যামব্রিজ। সূত্র: harvardmitcasecompetition.com

 

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খুনের এ ঘটনা বা ক্যামব্রিজের যাত্রা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা যায় গ্রেগরি’র কাছ থেকে; যিনি তাঁর মধ্যযুগীয় অপরাধমূলক গল্প ‘ম্যাথিউ বার্থোলিমেউ’ সিরিজের জন্য সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি এসব ঘটনাগুলো ফুটিয়ে তুলতে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। গ্রেগরি তাঁর স্বামী সাইমন বিউফোর্টের সঙ্গে গল্পটি লিখেছিলেন। নৃশংস হত্যা দিয়ে শুরুর পাশাপাশি গল্পটি অক্সফোর্ড থেকে পালিয়ে ক্যামব্রিজে নতুন বিদ্যাপীঠ স্থাপনকারী একদল পণ্ডিতকে অনুসরণ করে লেখা হয়। তাদের মধ্যে কে প্রকৃত হত্যাকারী তা খুঁজে বের করারও চেষ্টা করা হয়। এই অনুসন্ধানের নেতৃত্বে ছিলেন জেফ্রি গ্রাইম; যার ভাই ছিলেন অ্যাডাম অক্সফোর্ডে ফাঁসি দেওয়া নিরীহদের মধ্যে একজন ছিলেন।

গল্পের সমস্ত চরিত্রগুলো সেই সময়ের সত্যিকারের মানুষদের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই ১২০৯ সালে শীতের সময় অক্সফোর্ড ছেড়ে পালিয়ে অনিরাপদ যাত্রা শুরু করেছিল। গ্রেগরির গবেষণা সেই সময় সেই সকল পণ্ডিতদের নাম প্রকাশ করে; যারা সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। এর বেশি কিছু নয়।

সে সময় গ্রেগরি বলেছিলেন, তারা সম্ভবত পুরোপুরি শালীন পুরুষ ছিল। গল্পটি লেখার সময় তাকে কিছু বিবাদী পক্ষের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। গ্রেগরি আরও বলেন, খুন হওয়া মহিলাটি বেশ্যা হতে পারে বা নাও হতে পারে। কয়েকটি সূত্র থেকে জানা যায়, তাকে একটি তীর বৃদ্ধ করা হয়েছিল। গ্রেগরি আরও জানিয়েছেন, সম্ভবত হত্যার ঘটনাটি এখনকার তুলনায় অনেক বেশি সাধারণ ছিল। ধারণা করা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় যে, সমস্ত ঘটনাটি উত্তেজিত অবস্থায় ঘটেছিল যার অবসান ঘটে সহিংসতার মধ্য দিয়ে।

ওল্ড স্কুল এলাকা, এখানে সিনেট ভবনও অবস্থিত। সূত্র: keytothecity.co.uk

 

এবার গ্রেগরির প্রকৃত পরিচয় দেয়া যাক। সুসান্না গ্রেগরি তার ছদ্ম নাম, যিনি ক্যামব্রিজের একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন।চতুর্দশ শতাব্দীর মেডিসিনের একজন শিক্ষক এবং খুনের তদন্তকারী ম্যাথিউ বার্থোলমেউয়ের বৈশিষ্ট্যযুক্ত সিরিজের জন্য বেশ সুপরিচিত ছিলেন ছিলেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অক্সফোর্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের এক্সিলেন্স স্টাবলিশ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতার কারণে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়কে এক করে অনেক সময় অক্সব্রিজ নামে ডাকা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সংশ্লিষ্টদের ‘ক্যান্টাব্রিজিয়ান’ নামে ডাকা হয়। বর্তমানে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৩১টি কলেজ আছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ১০০টিরও বেশি লাইব্রেরি, যেখানে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি।

ক্যামব্রিজের গণ্ডি মাড়িয়েছেন বহু মহীরুহ। অনেক জ্ঞানীই বিভিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে নিউটন অন্যতম। ১৭ শতকে তার গতির সূত্র, ক্যালকুলাস ও মহাকর্ষের মতো আবিষ্কারগুলো সে সময়কার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গতিপথই পাল্টে দেয়। সঙ্গে বদলে দেয় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কেও। বিশ্ববিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজও ক্যামবিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ।

ক্যামব্রিজের বিশ্বখ্যাত ছাত্ররা

সেই থেকে চার্লস ডারউইন, স্যার আইজ্যাক নিউটন, স্টিফেন হকিং, ফ্রান্সিস বেকন, অগাস্টাস ডি মর্গান, গণিতবিদ মাইকেল ফ্রান্সিস আটিয়া, চার্লস ব্যাবেজ, জে জে টমসন, জেমস চ্যাডউইক, অমর্ত্য সেন, জামাল নজরুল ইসলাম, আল্লামা ইকবাল, লর্ড বায়রন, কবি জন মিলটন এমনকি বাংলাদেশি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ বসুর মতো মানুষরা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ৮শ’ বছর ধরে এখানকার শিক্ষার্থীরা বিশ্বব্যাপী আলো ছড়াচ্ছেন।


সর্বশেষ সংবাদ