ঢাকা কলেজে ছাত্র সংসদ নেই ২৬ বছর ধরে

১৮৪১ সালে উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা কলেজ। আধুনিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের জন্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি ১৭৯ বছরের গৌরবময় পথচলায় বিভিন্ন সময়ে ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ৯০-এর স্বৈরাচারের পতন সহ জাতীয় পর্যায়ের সকল গুরত্বপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। অতীত ও বর্তমান জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক নেতার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছে এই ঢাকা কলেজ থেকেই।

জাতীয় অঙ্গনে বিচক্ষণ দূরদর্শী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব উপহার দেয়ার কারখানা ছিলো ঢাকা কলেজ। সেই ঢাকা কলেজে দীর্ঘ ২৬ বছর অর্থ্যাৎ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন বা ছাত্র সংসদের কোন ধরণের কার্যক্রম। ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো তথ্য মতে, ১৯৩২–৩৩ সালের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হয়েছিলেন নুরুল হুদা। ওই সময় জিএস ছিল সর্বোচ্চ পদ।

এর পরবর্তী সময়ে ’৫০-এর দশকে ৮টি, ’৬০-এর দশকে ৭টি, ’৭০-এর দশকে ৩টি, ’৮০-এর দশকে মাত্র ১টি এবং সর্বশেষ ’৯০-এর দশকে ৪টি ছাত্র সংসদ গঠিত হয়। সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯৩–৯৪ সালে। ওই সময় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে হারুন-জাবেদ প্যানেল জয়ী হয়।

দেশের প্রাইমারি এবং মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ এবং নেতৃত্ব সৃষ্টিতে চেষ্টা চালানো হলেও ১৭৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম না থাকায় হতাশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা। দীর্ঘদিনের এই শূন্যতা ধরে কলেজের সার্বিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলেও মনে করছেন তাঁরা।

শিক্ষার্থীরা বলছে, ছাত্র সংসদ না থাকায় মুক্তবুদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় ব্যাঘাত ঘটছে। শুধু তাই নয় সেই সাথে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নাট্যকলাসহ সব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থেকেই শিক্ষার্থীরা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে বলেও জানান শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাদাত সাকিব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এই ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম না থাকায় সবকিছুতেই যেন স্থবিরতা জীর্ণতা চলে এসেছে। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে নিজের মেধাকে শাণিত করতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। আমরা চাই প্রশাসন খুব দ্রুতই ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করুক।

ছাত্র সংসদের কার্যক্রম গতিশীল করার দাবি জানিয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক জামাল উদ্দিন মাহী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র সংসদসহ সকল ধরণের গঠনমূলক কাজে ক্যাম্পাসে সবসময় সংশ্লিষ্ট থাকে। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এবং মেধার বিকাশে একটি কার্যকরী ছাত্র সংসদ আমাদের প্রাণের দাবি। সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যেকোন ধরণের জটিলতা থাকলেও সেসব জটিলতা কাটিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেবে কলেজ প্রশাসন।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সজীব। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সবসময় ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায়। সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।

ছাত্র সংসদ হলো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আশ্রয়স্থল। দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদের কোন কার্যক্রম না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা কলেজ শাখার সভাপতি বি এম জুবায়ের প্রধান। তিনি বলেন, দীর্ঘসময় ধরে ঢাকা কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ফলে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল সংগঠনকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সার্বিক কার্যক্রমে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায় সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাকা কলেজ শাখার সভাপতি নাহিদ উদ্দিন তারেক। বললেন, ছাত্র সংসদ হলো একটি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য। আমাদের সকলের প্রত্যাশা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি ছাত্র সংসদ থাকুক। এছাড়াও সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে সঠিক ছাত্র নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া খুবই দুঃখজনক বলে মনে করছেন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সর্বশেষ (১৯৯৩-৯৪) ভিপি হারুন-আর-রশীদ। তিনি বলেন, ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পুরনো কলেজ। এখানেই অনেক জাতীয় নেতার রাজনৈতিক অঙ্গনে সোনালী অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে। এমন পুরনো প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া খুবই হতাশাজনক। আগামীদিনের জাতীয় নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে এবং শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী করতে খুব দ্রতই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে কলেজ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান ও জানান তিনি।

তবে আশার বাণী শোনালেন ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক এটিএম মইনুল হোসেন। তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বা ছাত্র সংসদের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কলেজ প্রশাসন খুবই আন্তরিক। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু জটিলতা আছে। নির্বাচনের বিষয়টি আমরা একা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। সামগ্রিকভাবে যদি সিদ্ধান্ত আসে তবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঢাকা কলেজেও এর ব্যতিক্রম হবে না। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কলেজ প্রশাসন বিষয়টি বিবেচনা করবে বলেও জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ