স্বার্থের রাজনীতিতে সবাই স্বার্থান্ধ

মত নিয়ে মাতামাতিতে আমি বিশ্বাসী নই। মানুষ ভিন্ন পথে চলে বলেই মত ভিন্ন। যত পথ আছে তত মত থাকবে। আবার উল্টোটাও হতে পারে, মতের কারণেই পথ ভিন্ন হয়। আমি মাঠের বাইরের দর্শক হয়ে মতের মাতামাতিতে মাথা ফাটাতে একদমই অনিচ্ছুক। কারণ যে স্থান, সময় আমার না তা নিয়ে মত প্রকাশও অর্বাচীনতা। কিন্তু তারপরও যখন দেখলাম অনেকে ফেসবুকে নক করে জানতে চেয়েছে, কিছু বলতে বলেছে আবার কেউ কেউ কিছু প্রশ্নেরও উদ্রেক ঘটিয়েছে।

তখন ‘মৌনতাই সম্মতির লক্ষ্মণ’ এই বেড়াজাল ছিন্ন করে নিজের জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় আমি। আমি ছাত্রলীগ ছাড়ার পরে পারত পক্ষে ছাত্রলীগ নিয়ে কথা বলি নাই। কারণ ‘অধিকার ছাড়িয়া অধিকার রাখিবার মতো বিড়ম্বনা আর নাই।’ সুতরাং অধিকারের বাইরে থেকে ছাত্রলীগ নিয়ে কথা বলা আমার সমীচীন নয় এবং পার্টি আমাকে সেই এখতিয়ার দেয়ওনি।

ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার পরে বঞ্চিতদের একটি অংশ ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা বলছে, পদ পায় নাই এই কারণে তারা ক্ষুব্ধ না। তাদের থেকে আরো অনেক অযোগ্য ও বিতর্কিত অনেকে পদ পেয়েছে। এটাই তাদের ক্ষোভের কারণ। এই ধরনের ক্ষোভ রাজনীতিতে বিরাজমান স্বাভাবিক। কমিটি পরম্পরায় আমরা দেখেছি। কমিটি করার ক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধ থাকার কারণে এটি হয়। ৩০১ সদস্যের কমিটি কিন্তু কমিটিতে কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে কাকে কোন স্থানে পদায়ন করা হবে সেটার নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকার কারণে এই বিতর্ক হয়।

অনেক অযোগ্য ও বিতর্কিত যেমন পদ পায়, তেমনি অনেক অযোগ্য ও বিতর্কিত পদায়নের ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য মনে করে। এটা সমাধানের উপায় আপাতভাবে দেখলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে সমস্যা নির্মূল হবে না। এটা দূর করার উপায় হল, প্রাথমিক সদস্য ফর্ম পূরণ ও তথ্য সংগ্রহ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণে পানি নীতি নিলেই হয় না। স্রোতের সাথে মাটি ক্ষয় হয়, পলি জমে তাই মাটি নীতিও গুরুত্বপূর্ণ।

যা-ই হোক কথার পরিসর বাড়িয়ে লাভ নেই। অনেকে আক্ষেপের সুরে বলেছেন, ‘ভাই, আপনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে। আপনার অভিমত দেন।’ আবার অনেকে বলেছেন, ‘ভাই, আপনার আখের গোছানো শেষ এই কারণে কি আপনি নিষ্প্রভ?’ প্রথমটি সত্য না হলেও দ্বিতীয়টি কিছু অংশে সত্য। স্বার্থের রাজনীতিতে সবাই স্বার্থান্ধ। সবাই নিজের আখের গোছাতে চায়। সেটাতে যখন ছেদ ঘটে তখনই সে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। এখানে রাজনীতির শুদ্ধ পুরুষ বলতে কেউ না। আখের গোছানোর মধ্যে ২ বছর আগে ছাত্রলীগ থেকে সাবেক হয়ে রাজনীতির বড় পরিসরে ঢুকতে পেরেছি এটাই বড় লাভ। আবার কমিটিতে থেকে যদি আখের গোছানো যেত তাহলে হয়তো দুই বছর বেশি ছাত্রলীগ করতাম। আর আমি মোটেই ন্যায়ের পক্ষের লোক না। সেটা উপরের ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়। ন্যায়-অন্যায় যেহেতু আপেক্ষিক সেহেতু আমি পার্টির পক্ষের লোক।

আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হল, লড়াইটা যার তাকেই করতে হয়। আমাদের সময়ে আমি তা-ই মনে করেছি। কারো পরামর্শ বা কে কি বলল সেটার অপেক্ষায় থেকে লড়াই হয় না। অন্যের গুরুত্বপূর্ণ মতামতের সমর্থন নিয়ে লড়াই হয় না। নিজেকে যোদ্ধা হিসাবে পরিণত করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। যুক্তির আরশিতে তার বৈধতা থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেখানে সমর্থন তৈরি হবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাইরের কেউ শুরু করে নাই। বা ২৫ মার্চের আগে বাইরের সমর্থনও প্রয়োজন ছিল না। বাঙালির সম্মিলিত প্রয়াসে অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ একটা সময় বৈশ্বিক মোড়লদের কানে পানি দেয়। এর পক্ষে জনসমর্থন তৈরি হয়ে যায়। বাইরের সমর্থন যদি যুদ্ধক্ষেত্রে বড় মনে করা হয় তাহলে বিজয় ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায়ের চাইতে সময় এবং কৌশল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সময় এবং কৌশলের উপর বিবেচনাপ্রসূত। নিয়ন্ত্রণ থাকলে অন্যায় যুদ্ধেও জেতা যায়। বৈপরীত্যে উল্টোটাও ঘটতে পারে।আমি কোন কিছু খারিজ করার জন্য বলছি না। শুধুমাত্র প্রশ্নগুলো তুলেছি এইগুলো ঝালায়ের জন্য---

* যারা আন্দোলন করছেন তারা সবসময় আন্দোলনকে ন্যায়ভিত্তিক বলে ব্র‍্যান্ডিং করছেন। সবসময় এটাই হয়। আপনি কি সবসময়ের ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন কিনা নিজেকে প্রশ্ন করবেন? আমি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থাকি না বা থাকতে পারি না।

* গত কমিটিতে সম্মেলনের দাবিতে আন্দোলনে পক্ষে বিপক্ষের শুধুমাত্র অবস্থান পরিবর্তন হইছে। পরিবর্তিত অবস্থানের কারণে মুখোশের পরিবর্তন হইছে। একটু ফ্ল্যাশ ব্যাকে গেলেই বুঝতে পারবেন। অবস্থান পরিবর্তনের কারণে কর্মকাণ্ডও পরিবর্তিত হয়। একই অবস্থানে একই কর্মকাণ্ডে আমরা থাকতে পারি না রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে।

* কমিটি হওয়ার আগের দিন যে আন্দোলনের পক্ষে ছিল কমিটিতে অবস্থান হওয়ায় সে নাই। আবার কমিটি হওয়ার আগের দিন যে এই চক্রের বাইরে ছিল কমিটিতে অবস্থান না হওয়ায় সে এসে যোগ দিয়েছে। এটাই রাজনীতি যোগ বিয়োগ। এটাকে সামগ্রিক চেতনার লড়াই হিসাবে ব্র‍্যান্ডিং করতে চাইলেও আসলে তা ছাত্রলীগের বঞ্চিতদের চেতনার লড়াই।

* ছাত্রলীগের সাবেক কেউ কেউ বলেছিল, সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কথা বলা নাকি দেশদ্রোহিতার শামিল ছিল। এখন তাদের অনেকে এখন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এর বিরুদ্ধে বলার জন্য উস্কানি দিচ্ছেন। এমন প্লাটফর্মে আমি কিভাবে দাঁড়াই সেটাই প্রশ্ন?

সর্বশেষ বলতে চাই, সময়ের তাৎপর্যে এই আন্দোলন তার গুরুত্ব হারিয়েছে। আগেই বলেছি সময়কে যদি পক্ষে করে নেওয়া যায় এবং কৌশল যদি শাণিত থাকে তাহলে অন্যায় যুদ্ধেও জেতা যায়। এই আন্দোলনের সময় চলে গেছে। এই আন্দোলন শুরু হওয়া উচিত ছিল গত বছরের অক্টোবরে পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবিতে। তখন আন্দোলন না করতে পারা এই আন্দোলনকারীদের বড় ব্যর্থতা।

সবাই হয়তো নিজের চিন্তা করেই কেউ তখন কণ্ঠ তোলে নাই। সবাই মনে মনে ভাবছে আমার নামটা থাকলেই হলো। ভাইয়ের সাথে তো আমার ভাল সম্পর্ক। ভাই আমার নাম রাখবে। এই চিন্তায় এই আন্দোলন সময়ের গুরুত্ব হারিয়েছে। আপনি ছিলেন নিজের নামের অপেক্ষায়। আর তখন সময় ছিল আপনার অপেক্ষায়। সময় চলে যাওয়ার পর এই সাড়া সময়কে ধরতে পারেনি।

পুনশ্চ বলছি— সময় ও কৌশল যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্য কারো মতামত বা সমর্থনের উপর যুদ্ধে নামলে সে যুদ্ধে বিজয় হলেও বিজয় ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

লেখক: সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ


সর্বশেষ সংবাদ