ছাত্র সংসদের সভাপতি থেকে জনপ্রিয় রাষ্ট্রীয় নেতা কানহাইয়া

  © টিডিসি ফটো

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে এখন চলছে ম্যারাথন জাতীয় নির্বাচন। সেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর নামই উচ্চারিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তবে আরও একটি নাম ব্যাপকভাবে সামনে এসেছে। তবে এ নামটি কিন্তু চমক নয়, ২০১৬ সালেই ওই তরুণ কাপিয়ে দিয়েছিলেন দিল্লীর মসনদ। তিনি কানহাইয়া কুমার।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে বেগুসরাইয়ে সিপিআইয়ের প্রার্থী হয়েছেন কানহাইয়া কুমার। তিনি এখন এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন যে, কোন স্থানে গেলে সেখানে হাজারো মানুষের ভিড় পড়ে যায়। সামলাতে হিমসিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে। মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে মনোনয়ন জমা দেন বেগুসরাইয়ের সিপিআই প্রার্থী কানহাইয়া কুমার। গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে তিনি জেলা সদরের দিকে রওনা দিতেই কয়েক হাজার লোকের মিছিল জুড়ে যায় তাঁর সঙ্গে। 

এবারের জাতীয় নির্বাচনে তিনি নতুন একটি বিষয় নিয়েও তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কানহাইয়ার নির্বাচনের খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু এতে তিনি দমে যাননি। ভারতের নির্বাচন কমিশনের নির্ধারণ করে দেওয়া সীমা অনুযায়ী, একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৭০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারে খরচ করতে পারবেন। ওই বিপুল অর্থ সংস্থানের জন্য কানহাইয়া আশ্রয় নিয়েছেন ক্রাউড ফান্ডিংয়ের। সেখানে মাত্র একদিনেই জমা হয়েছে ৩১ লাখ টাকা। ভারতে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া রাজনীতিবিদদের ভিড়ে এটি দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়।

অর্থ সংগ্রহ করার জন্য এই উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ার ডেমোক্র্যাসি’। এতে সাধারণ জনগণ অনেকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দিয়েছেন। অনেকে আবার লাখ টাকাও দান করেছেন। আর সাবেক এক প্রকাশকের পক্ষ থেকে অনুদান এসেছে পাঁচ লক্ষ টাকা। ৭০ লক্ষ টাকা উঠে গেলে ওই ক্রাউড ফান্ডিং বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর থেকে সহজেই অনুমেয়, কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন কানহাইয়া কুমার।

কিন্তু কে এই কানহাইয়া কুমার? তার এত জনপ্রিয়তার কারণ কি? এসব প্রশ্নের উত্তর এক কথা বলতে গেলে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে, দরিদ্র-মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন তিনি। আর সে কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানলেরও শিকার হয়েছেন কানহাইয়া। ইতিহাস বলে, এভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত নেতারাই পরবর্তীতে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

বিহারের বেগুসরাইয়ের এক গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠা। বঞ্চনা, অপমান সয়েছেন। দুবাইয়ে এয়ার কন্ডিশনার সারানোর চাকরি করতে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা— কানহাইয়ার যাত্রাপথই আসলে সেই প্রশ্নের উত্তর। কোনও গরিব পরিবারের মেধাবী ছেলেকে যে বাধাগুলোকে ডিঙিয়েই এগিয়ে চলতে হয়, কানহাইয়াও সেই গল্প বলেছেন। সঙ্গে বলেছেন, প্রতিটি অভিজ্ঞতা তাঁকে কী শিখিয়ে গিয়েছে।

ভারতের প্রখ্যাত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন কানহাইয়া কুমার। তখন ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। তবে ২০১৬ সালের একটি ঘটনার পর তিনি দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন। ভারতের পার্লামেন্টে হামলার দায়ে কাশ্মিরের নাগরিক আফজাল গুরুর ফাঁসির প্রতিবাদে ২০১৬ সালে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ দেখান তিনি। সে সময় একটি সমাবেশে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উঠে এবং সেই অভিযোগে তাকে গ্রেফতারও করা হয়।

কানহাইয়ার সঙ্গে অভিযোগ এসেছিল, অপর আলোচিত ছাত্র নেতা উমর খালিদ-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধেই। তার সঙ্গে দেশদ্রোহের অভিযোগে জেলে যেতে হয় খালিদ ও অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে। এরমধ্যে কানহাইয়া আফ্রিকান স্টাডিজ-এ গবেষণা করছিলেন। পরে তিনি তার পিএইচডি সম্পন্ন করে ‘ডক্টর’ হন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির বিবেচনায় দোষী বলে গণ্য হওয়ায় এখনও পিএইচডি শংসাপত্র হাতে পাননি উমর ও অনির্বাণ।

এই দেশদ্রোহিতার মামলা নিয়েও নাটক হয়েছে অনেক। কানহাইয়া কুমারসহ দশ জনের বিরুদ্ধে দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্টে ১২০০ পাতার চার্জশিট জমা দেয় দিল্লি পুলিশ। কিন্তু আদালত দিল্লি পুলিশের জমা দেওয়া সেই চার্জশিট গ্রহণ করেনি। কারণ ভারতীয় দণ্ডবিধিতে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগে চার্জশিট জমা দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু কানহাইয়াদের চার্জশিটে দিল্লি সরকারের অনুমতি ছিল না। এ বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেয়নি অরবিন্দ কেজরীওয়ালের প্রশাসন।

তাদের মতে, বাম ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে তিন বছর আগে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনেছিল আরএসএসের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি। সে সময় দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে করা তদন্তে কানহাইয়া বা তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের কোনও প্রমাণ পাননি নয়াদিল্লির জেলাশাসক। ফলে যে ঘটনায় একবার কানহাইয়াদের ক্লিন চিট দিয়েছে কেজরীওয়াল সরকার, সেই মামলায় নতুন করে দেশদ্রোহের অভিযোগে দিল্লি পুলিশকে তদন্ত করার অনুমতি দিলে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে আপ শিবির।

এছাড়া দেশের কোনও বিষয় নিয়ে বা দেশের সমালোচনা করলেই সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ নয় বলে অভিমত দেয় জাতীয় আইন কমিশন। তাদের মতে, হিংসার মাধ্যমে বা অন্য বেআইনি পথে সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে কিছু করা হলে, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা যেতে পারে।

প্রায় ২০ দিন জেল খেটে কানহাইয়া যখন বেরিয়ে আসেন তখন তার মূল জনপ্রিয়তা প্রকায় পায়। অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে তিহাড় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ছাত্র সমাবেশে বলেন, ‘দেশ থেকে মুক্তি নয়, দেশের ভেতরে মুক্তি চাই আমরা। আজাদি পেটের জ্বালা থেকে, আজাদি দুর্নীতি থেকে, আজাদি মনুবাদ থেকে।’ কানহাইয়া যখন এসব কথা বলছিলেন, উপস্থিত জনতা তখন উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন। ওইদিনই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘উনি ‘সত্যমেব জয়তে’ বলেন। সে কথা তো সংবিধানেই রয়েছে। আমরা তাই একই কথা বলি। উনি সব সময়ে ‘মন কি বাত’ বলেন, অন্য কারও মনের কথা শোনেন না।’ হাসি হাসি মুখে চোখা বিদ্রুপে সেদিন ভাসিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে।

তার মুক্তির দিন তিহাড়ের সামনে ছিল ব্যাপক ভিড়। সকলেই চাইছিলেন একবার কানহাইয়াকে দেখতে। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বেগুসরাইয়ের ওই ছাত্রকে দেখতে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করছিলেন অফিস ফেরত দিল্লিবাসীও। জেল থেকে এক-এক করে গাড়ি বেরোয়, আর ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। কানহাইয়াকে ক্লিনচিট দেয় দিল্লি প্রশাসন। বিকেল পাঁচটার দিকে তিহাড় জেলের সব ক’টি প্রবেশ পথে হঠাৎ পুলিশ পাহারা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কোন গেট দিয়ে কানহাইয়াকে বার করা হবে তা বুঝতে না দেওয়ার জন্য এই কৌশল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনতাকে আশাহত হতে হয়। কারণ পুলিশ জানায়, জেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন কানহাইয়া। জেলকর্মীদের পরিবাররা যে গেট ব্যবহার করে, সেখান দিয়ে বার করা হয় কানহাইয়াকে। তারপর এসকর্ট করে তাঁকে পৌঁছে দেওয়া হয় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই ক্যাম্পাস থেকেই সাদা পোশাকের পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল ছাত্রসংগঠনের প্রেসিডেন্ট, বাম সংগঠন এআইএসএফের নেতা কানহাইয়াকে।

ভারতের রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দেওয়া ছাত্রনেতা কানহাইয়া এবার লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন। যেখানে উপস্থিত হচ্ছেন সেখানেই জনতার ভিড় পড়ে যাচ্ছে। আগামী ২৫ শে এপ্রিল বিহারে বেগুসরাই আসনে লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বেগুসরাই থেকে সিপিআইয়ের প্রার্থী কানহাইয়া কুমারের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং। কানহাইয়া জিতবেন কিনা সে বিষয়ে এখনো কেউই নিশ্চিত নন। তবে তিনি দেশটির রাজনীতিতে যে বড়সড় একটা ধাক্কা দিয়েছেন তা বলে না দিলেও চলে। হয়ত তার হাত ধরেই দেশটির রাজনীতিতেও সূচনা হচ্ছে পরিবর্তনের।

তথ্যসূত্র: ভারতীয় গণমাধ্যম।


সর্বশেষ সংবাদ