মাধ্যমিকে পাস না করলেও দেশপ্রেমে শ্রেষ্ঠ তাঁরা

চার বীরশ্রেষ্ঠ
চার বীরশ্রেষ্ঠ

‘ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়, ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে/ গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে আজো রোমাঞ্চকর;/ ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়, কে আছে আজকে ওদের ফিরায়।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মতো মুক্তিযোদ্ধাদেরও ফেরানো যায়নি। যাবেই বা কেন; ওরা যে বাংলার দামাল ছেলে, সূর্য সন্তান। বাংলা ও বাঙালীকে বাঁচাতে মানুষরূপী জানোয়ার নিধনই যে ওদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাদের এই অকুতভয় যুদ্ধের কারণে জাতি আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছে। আর প্রেরণা হিসেবে পেয়েছে সাত বীরশ্রেষ্ঠ।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ।যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে এই পদক দেয়া হয়েছে । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরই এই পদক দেয়া হয়। আর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের একটি অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যারা জীবন উৎসর্গ করলেন; কেমন তাদের পরিবার? বেড়ে ওঠাই বা কীভাবে? কিংবা তাদের লেখাপড়া কোন পর্যন্ত? দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দেয়া সাত বীরের ৪ জনই বড় হয়েছেন অভাব-অনটনের পরিবারে, বেশ সংগ্রাম করে। মাত্র ৫ ক্লাস পড়েছেন, এমন বীরও রয়েছেন এই চারের মধ্যে। বাকীরাও পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে কপালে জোটাতে পারেননি মাধ্যমিকের শিক্ষাটুকু। যা হয়েছে, সেটাও সামান্য।

তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, বীরশ্রেষ্ঠদের অন্যতম মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুরে (বর্তমান নাম রউফ নগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। জানা যায়, যথেষ্ট সাহসী ও মেধাবী ছিলেন আব্দুর রউল, কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল না। তারপরও বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। কিন্তু ১৯৫৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি। সংসারের হাল ধরতে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৩ সালের ৮ মে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। সে সময় তাঁকে ৩ বছর বেশি বয়স দেখাতে হয়েছিলো চাকরিটি পাওয়ার জন্য।

আরেক যোদ্ধা নূর মোহাম্মদ শেখের বেড়ে ওঠাও বেশ সংগ্রাম করে। ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে নূর জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায়, অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারানোর ফলে শৈশবেই ডানপিটে হয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা করেননি।

১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। কিন্তু তিনিও পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচ্চ বিদ্যালয়ে দু-এক বছর অধ্যয়ন করেন।

এছাড়াও মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের জীবনে থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তদানিন্তন যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে জন্ম তাঁর। পিতার নাম আক্কাস আলী মন্ডল এবং মায়ের নাম মোসাম্মাৎ কায়মুন্নেসা। শৈশবে তিনি খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করেন।

তবে ব্যতিক্রম ছিল আরেক তিন বীরশ্রেষ্ঠ। এর মধ্যে মতিউর রহমান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। যা এখন মতিনগর নামে পরিচিত। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ। তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন।

১৯৬৬ তে তিনি বরিশাল বি.এম (ব্রজমোহন) কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। যতদূর জানা যায়, পাতারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। মুলাদি মাহমুদ জান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তবে তিনিও বেড়ে ওঠেন কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তথ্যমতে, পিতার আর্থিক দৈন্যতার কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সেই মামার বাড়ি মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে যান জাহাঙ্গীর।

নোয়াখালীর বাঘচাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমিষাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন আরেক বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন। এখান থেকে এসএসসি পাশ করে ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন।

বেড়ে ওঠা কিংবা লেখা পড়া যাই হোক- তাদের সংগ্রামই যে বাঙালিকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে। সেই সঙ্গে এনে দিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ।


সর্বশেষ সংবাদ