প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা

বাসায় টিভির ক্লাসে মন বসছে না

করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রায় পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ রয়েছে। এমনকি সহসা খোলারও সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় পড়াশোনা ভুলতে বসেছে দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। যদিও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ‘ঘরে বসে শিখি’ নামে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার চালু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। কিন্তু তেমন সাড়া মেলেনি বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।

নোয়াখালী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (প্রভাতী শাখার) ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তাসপিয়া তারান্নুম অহনা। করোনাকালে তার পড়াশোনার অবস্থা জানতে চাইলে সেই জানায়, বাসায় টিভির ক্লাসে মন বসছে না। পড়াশোনার চাপ না থাকায় মনোযোগ ও আসছে না। যার ফলে আগে যা পড়েছি সব ভুলতে বসেছি। কথা হয় তার অভিভাবকের সাথে, তিনি জানান, র্দীঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার প্রতি অমনোযগী হয়ে পড়ে সে। তিনি আরও জানান, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার করণে যারা টিউশন পড়াতেন তারাও এখন নেই যার ফলে টিউশনও পড়াতে পারছি না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিনিধির সাথে কথা হয় জেলার প্রত্যান্ত অঞ্চল হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সোলাইমানের সাথে। র্দীঘ বন্ধে শিক্ষার্থীদের সাথে পড়াশোনার হালচাল জানতে চাইলে তিনি জানান, বন্ধের পর থেকে আমাদের সাথে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ নেই। আমাদের এইখানে বিদু্ৎ সংযোগ নেই তাই আমাদের শিক্ষার্থীরা টিভির ক্লাসে অংশগ্রহন করতে পারছে না।

অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানে আমাদের শিক্ষকরা। আর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবার একদমই গরীব তাদের অনেকের স্মার্ট্ ও ফোন নেই। যেহেতু এটা দ্বীপ অঞ্চল নেটওর্য়াক ব্যবস্থা ও ভালো নয় তাই আমাদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া ও সম্ভব হচ্ছে না।

সরকার টিভিতে প্রাথমিকের ক্লাস দেখাচ্ছে ৭ এপ্রিল থেকে। বাসায় টিভি না থাকায় ক্লাস করতে পারছে না খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার দক্ষিণ বাবুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ত্রয়া চাকমা। তার পরিবার জানায়, বাসায় টিভি নেই তাই ক্লাস করতে পারছে না। এছাড়াও বাড়িতে পড়ানোর মতো কেউ নেই। তাই র্দীঘদিন পড়াশোনা বিমুখ থাকতে হচ্ছে ত্রয়াকে। এই ছাড়াও এই অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের বড় অংশই গরিব পরিবারের।

একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে বলে সিলেট ওসমানীনগর ধনপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা লাভলী শবনম। তিনি জানান, আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করি তাদের পড়াশোনার খোঁজ খবর নিয়ে থাকি । বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের বাড়ীতে টিভি না থাকায় তারা ক্লাসে অংশ গ্রহন করতে পারছে না। এছাড়াও লোডশেডিং সমস্যা তো রয়েছে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অভিভাবকদের সাথে টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাস নিয়ে কথা বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। জানা যায় নানান অভিযোগ। তার মধ্যে রয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ সংক্ষিপ্ত ক্লাস, লোডশেডিং, গতানুগতিক ধারার পাঠদান কার্যক্রম, মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার না থাকা, অনভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করা, রুটিন অনুযায়ী নির্ধারিত ক্লাস না হওয়া এবং মনিটরিংয়ের অভাব।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার আগে গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে প্রতিদিন ৬২৫ মিনিট পড়ালেখায় ব্যয় করলেও এখন তারা মাত্র ১২৪ মিনিট পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ালেখার সময় কমে এসেছে মাত্র দুই ঘণ্টায়। সেই হিসাবে ৮০ শতাংশ সময় কমেছে পড়াশোনার। এছাড়া টেলিভিশন ও অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারেনি ফলে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ এ দুটি অনুষ্ঠান দেখছে এবং এক শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে। যারা টিভি ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে তারা আবার টেলিভিশনে ক্লাস অনুসরণ করাকে বেশ কঠিন বলে মনে করছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলছেন, সংসদ টিভির মাধ্যমে ৯৩-৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। বাকি ৬-৭ শতাংশ শিক্ষার্থী যাতে ক্লাসে অংশ নিতে পারে, এ বিষয়ে এরই মধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এইদিকে আসছে আগামী নভেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং জেএসসি পরীক্ষা এরপরই হওয়ার কথা বার্ষিক পরীক্ষা। এখন পড়াশোনা বিমুখ শিক্ষার্থীরা এইদুটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কতটা সুফল বয়ে আনবে সেইটা দেখার বিষয়। যদিও মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, এই বছর পাবলিক পরীক্ষা হবে কিনা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকারের উচ্চপর্যায়। তবে এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ এর মতে, এ বছর পিএসসি এবং জেএসসি দুটি পাবলিক পরীক্ষাই স্থগিত রাখলে বিরাট কোনো ক্ষতি হবে না। বরং শিক্ষার্থীদের পড়ার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। তাই যারা বেশি পিছিয়ে পড়েছে তাদেরকে বাড়তি সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। এইজন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমাদের সকলকে আস্থা ধরে এগিযে যেতে হবে। অন্যথায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।


সর্বশেষ সংবাদ