বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপের বৃত্তান্ত

  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহনের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউনেস্কোর হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমাদের দেশ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬০০০০ এর কাছাকাছি। আমাদের অনেকেরই ধারনা খুব মেধাবী এবং আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে বিদেশে পড়তে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারনাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কেউ কেউ উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে কিভাবে কি করতে হবে তা বুজে উঠতে পারেননা। তাই বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা থাকলে প্রথমেই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনার উচিত স্বচ্ছ ধারণা রাখা।

সিদ্ধান্ত গ্রহন ও পরিকল্পনা: বিদেশে পড়াশোনা করতে হলে অনেক আগে থেকে (অন্তত এক বছর) পরিকল্পনা করা জরুরি। সেই সঙ্গে নিজের আর্থিক সামর্থ্য, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, বুঝে দেশ, শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করতে হবে। এছাড়া নির্বাচিত দেশে পড়াশুনার মান, আপনার যোগ্যতা দিয়ে ভিসা পাবার সম্ভবনা, সেসন ও ভিসা প্রসেসিং সময়, কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ কেমন, বৃত্তিপ্রাপ্তির সম্ভবনা আছে কিনা এসব আগে থেকেই জেনে নিলে পরবর্তী সময়ে হয়রানি হতে হবেনা। এধরনের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হলে সোশ্যাল মিডিয়ার বড় প্লাটফর্মগুলোতে (Facebook group : Australian Student visa & Other Visa Information for Bangladeshi students) জয়েন করে সাহায্য চাইতে পারেন।

যেসব প্রস্তুতি দরকার হবে

১. ভাষা দক্ষতার প্রমাণ: উচ্চ শিক্ষায় বিদেশে পড়তে যেতে ইংরেজি বা ঐ দেশের ভাষার দক্ষটা প্রমাণ দিতে হয়। আইইএলটিএস, পিটিই, টোফেল, স্যাট অথবা জিআরই, এগুলো ভাষা দক্ষটা যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টেস্ট। উল্লেখিত টেস্ট ছাড়াও মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশান দিয়ে কোন কোন দেশে আবেদন করা যায়। তাই আপনি কোন দেশে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবেন তার উপর নির্ভর করে ভাষা দক্ষতার টেস্ট নির্ধারণ করতে হয়।

২. পড়াশোনার ফলাফল: বাংলাদেশে পড়াশোনার ফলাফলের ওপর বিদেশে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ব্যাপারটিও অনেক সময় নির্ভর করে। পৃথিবীর বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আপনার বিগত পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ৬০% বা তারও বেশী নম্বর থাকা উচিত।

৩. আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণপত্র: কোন কোন দেশে আবেদন করতে শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবক তার পড়াশোনাকালীন সবখরচ বহন করতে সক্ষম তা ব্যাংক স্টেটমেন্ট দিয়ে প্রমান দিতে হয়। তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে অভিভাবক বানিয়ে বা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া স্পন্সর সংগ্রহ করে ভিসা আবেদন করা অনুচিত।

দেশ নির্বাচন: প্রথমেই একজন শিক্ষার্থীকে ঠিক করতে হবে তিনি কোন দেশে পড়তে যেতে চান। কারণ একেকটি দেশের পড়াশোনার মান, খরচ, ভর্তি যোগ্যতায় পার্থক্য আছে। আপনি যে দেশে যাবেন তার পড়াশোনার মাণ, টিউশন ফি, কোর্সের মেয়াদ, পার্টটাইম জব সুবিধা, স্কলারশিপের সুবিধা, দেশের আবহাওয়া, পোড়াশোনা শেষে চাকুরী ও নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ এ সবকিছু বিবেচনায় রাখতে হবে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ উন্নত দেশগুলো চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে বিদেশি ডিগ্রিধারীদের পড়াশোনা শেষে অভিবাসনেরও সুযোগ দিয়ে থাকে। নিন্মে কয়েকটি দেশের বিস্তারিত তুলে ধরা হল—

১. আমেরিকা
বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের শিক্ষার্থীর কাছে আমেরিকা উচ্চশিক্ষার প্রধান গন্তব্য। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলে ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি সচ্ছল আর্থিক অবস্থাও জরুরি। তবে শক্তিশালী একাডেমিক রেকর্ড থাকলে দেশটির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া অনেকটাই সহজ। আমেরিকায় এসোসিয়াট ডিগ্রী, ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পি এইচ ডি প্রোগ্রামে যাওয়া যায়। এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেদে ভাষা দক্ষটা প্রমাণের জন্য IELTS, TOEFL, SAT, GRE এসবের এক বা একাধিক টেস্ট স্কোরের দরকার হয়।

২.অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের পছন্দের তালিকায় বর্তমান বিশ্বে তৃতীয়।এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্কলারশীপ এবং ওয়েভার নিয়ে ব্যাবসা প্রশাসন, প্রকৌশল, নার্সিং, স্বাস্থ্য, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ডিপ্লোমা, স্নাতক, স্নাতোকোত্তর ও পিএইচডি করার যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাণের শিক্ষা প্রদানে দেশটির অনেক সুনাম আছে। উন্নত ও নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা, পড়াশুনার মান, বাংলাদেশের মত আবহাওয়া, পড়াশুনা শেষে স্থায়ীভাবে বসবাস (Permanent Residancy) ও কাজের সুযোগ এবং ছাত্রাবস্থায় পার্টটাইম কাজের সুবিধা থাকার কারণে বহিঃবিশ্বের অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের মত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও অস্ট্রেলিয়াকে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখে। প্রতিবছর সারাবিশ্ব থেকে প্রায় ছয়-সাত লক্ষ শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়াতে পড়তে যায়।

৩. কানাডা
আর্ন্তজাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা।কম খরচে পড়ালেখা, শিক্ষাজীবন শেষে সহজেই পছন্দনীয় পেশায় যোগদান, নাগরিক সুবিধার কারণে অন্যান্য দেশের ন্যয় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কাছেও বিদেশে উচ্চ শিক্ষার পছন্দনীয় দেশের একটি কানাডা।

৪. ব্রিটেন
বার অ্যাট ল, সি এ এবং অন্যান্য প্রোগ্রামগুলোর জন্য যুক্তরাজ্য সারাবিশ্বে সুপরিচিত। যুক্তরাজ্যে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সগুলো তিন বছরের হয়ে থাকে। পড়াশোনার সময় শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খন্ডকালীন কাজ করতে পারবেন। তবে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর এক নতুন ঘোষণায় জানিয়েছে, ২০২০ সাল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর কর্মসংস্থানের জন্য দুই বছর যুক্তরাজ্যে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা।

৫. ইউরোপ
ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও স্থানীয়ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে এ দেশগুলোই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পছন্দের । এখানকার বেশিরভাগ দেশেই পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ রয়েছে। পড়াশোনা শেষে অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতিও পাওয়া যায়।

৬. চীন
চীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমান বৈশ্বিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং শিল্পায়নের বিশেষ ক্ষেত্রকে বিবেচনায় এনে কোর্স প্রণয়ন কর। চীনে প্রচুর বৃত্তিও পাওয়া যায়। একেবারেই কমখরচে বা অনেকক্ষেত্রে কোন খরচ ছাড়াই স্টিপেন্ড এর টাকাসহ চীনে পড়াশোনা করতে পারবেন। এখানে স্পন্সর বা ফান্ড দেখানর মত ঝামেলা নেই বললেই চলে। চীনে পড়ার মাধ্যম ইংরেজি ও চাইনিজ। তবে আপনি ভিসা পাবার পরও চীন গিয়ে আপনার মুল প্রোগ্রাম শুরু করার পূর্বে চাইনিজ ভাষা শিখতে পারবেন। যাদের পরাশুনার মাঝখানে গ্যাপ আছে তারাও চীনে আবেদন করতে পারেন।

৭. মালয়েশিয়া
কম খরচে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে খরচ বহনের উদ্দেশ্য থাকলে পর্যটনকেন্দ্রিক দেশ মালয়েশিয়া প্রথম পছন্দ হওয়ার কথা। তাছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও খাদ্যগত মিল রয়েছে। কিছু পাবলিক ইউনিভার্সিটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার জন্য ব্যাংক স্পন্সর ও ভাষা দক্ষতার (ielts)প্রমান না থাকলেও চলে। এইচএসসি বা এ-লেভেলে ন্যূনতম ২ পয়েন্ট থাকা প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন: দেশ বাছাইয়ের পরে ঠিক করতে হবে যে, আমার সাবজেক্ট ও আর্থিক সামর্থ্যের সঙ্গে মিলিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যেতে পারে। এক্ষেত্রেও একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম বা চাহিদা, টিউশন ফির সঙ্গে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য থাকে। বিষয় নির্বাচনে সতর্কতাও জরুরি। কারণ বিদেশে চাহিদা আছে এমন অনেক বিষয়ের চাহিদা আমাদের দেশে তেমন নেই। মানসম্মত শিক্ষাদান করে, তুলনামূলক টিউশন ফি কম এমন বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করাই ভালো। শিল্পসমৃদ্ধ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ আছে।

স্কলারশিপ: বিভিন্ন দেশ বছরজুড়েই স্কলারশিপের ঘোষণা দেয়। ফুল-ফান্ড স্কলারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় টিউশন ফি, শিক্ষা উপকরণ, লাইব্রেরি ফি, বাসস্থান, যাতায়াত, মেডিকেল খরচও বহন করছে কর্তৃপক্ষ। যা উচ্চ শিক্ষায় দেশের বাহিরে পড়তে যেতে কঠিন একটি বাধা দূর করে দেয়। আর সেটি যদি আংশিক স্কলারশিপ হয়, এক্ষেত্রে প্রথমে দেখতে হবে স্কলারশিপের মেয়াদ কত, সেটি নবায়ন করা যাবে কিনা । বিদেশে বিনা খরচায় পড়াশোনা করতে চাইলে আপনাকে এমন কিছু দেশে আবেদন করতে হবে যে দেশগুলোতে কোন টিউশন ফী নেই। জার্মানি, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ কিছু দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি গুনতে হয় না।

কি কি কাগজপত্র লাগবে: স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে গেলে কি কি কাগজপত্রের প্রয়োজন পরবে তা নির্ভর করে আবেদনকারীর সার্বিক অবস্থার উপর। সাধারণত যেসব কাগজপত্র প্রস্তুত রাখতে হয় সেগুলো হল- শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ও নম্বরপত্র , পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র,জন্মনিবন্ধন সনদ, ব্যাংক সলভেন্সি বা স্পন্সর-সংক্রান্ত কাগজপত্র, ভাষা দক্ষতা সনদ, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি ইত্যাদি। কিছু কিছু ডকুমেন্টস নোটারি করা লাগতে পারে।

সাবধানতা: আন্তর্জাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন এডুকেশন কন্সালটেন্ট (PIER-QEAC সার্টিফাইড) এর সাহায্য নিতে পারেন, এতে আপনার ভিসার সিদ্ধান্ত পেতে অনেক কমসময় লাগবে আর মনে রাখবেন, একবার ভিসা পেতে ব্যর্থ হলে, পরবর্তীতে অফার লেটার/ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সর্বোপরি, কোনো চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হবেন না। ভিসা পাবার নূন্যতম যোগ্যতা না থাকলে অর্থের বিনিময়ে কেউ আপনাকে ভিসা পাইয়ে দিতে পারবেনা । আপনারা সহযোগিতার জন্য আমাকে ই-মেইল করতে পারেন নিচের ই-মেইল এ। আজ এ পর্যন্তই। সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।

 

লেখক: মোহাম্মদ ইউ মজুমদার
(অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এবং PIER, ISANA Study UK [British Council] সার্টিফাইড ইন ইন্টারন্যাশনাল হায়ার এডুকেশনাল প্রফেশনাল)
সি ই ও, গ্লোবাল স্টাডি নেটওয়ার্ক
Studentvisainfo4aus@gmail.com
সিডনি,অস্ট্রেলিয়া থেকে

 


সর্বশেষ সংবাদ