রাবির বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ইয়ার ড্রপ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার

  © ফাইল ফটো

২০০৮-০৯ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণিত বিভাগে ভর্তি হন ৬৮০ শিক্ষার্থী। কিন্তু নিয়মিত হিসেবে স্নাতক পাশ করেন ৩৪৩ জন, যা ভর্তির প্রায় অর্ধেক। শুধু গণিত বিভাগেই নয়, প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ফলিত গণিত, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগ, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেও।

এসব বিভাগে প্রথম বর্ষে যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, তার প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক শেষ করতে পারছে না। একজন শিক্ষার্থী একাধিকবার ফেল করছে বিভিন্ন বর্ষে। বিভাগগুলোতে পাস করতে না পেরে প্রতিবছর ইয়ার ড্রপ দিচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। 

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নিয়মিত অনুপস্থিত, তাদের মুখস্থ ও নোট-শিট নির্ভর পড়াশুনা, শিক্ষকরা ক্লাসে সঠিকভাবে পাঠদানে ব্যর্থ প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর ইয়ার ড্রপের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার প্রতি মনযোগের পাশাপাশি প্রচলিত পাঠদান পদ্বতির পরিবর্তনের তাগিদ দেন তারা।

ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৭২০ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু নিয়মিত হিসেবে পাশ করেন ৩১১ জন, এ সংখ্যা ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর অর্ধেকের কম। রসায়ন বিভাগে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪৪০ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু নিয়মিত হিসেবে স্নাতক পাশ করেন ২৩৭ জন। ফলিত গণিত বিভাগে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ২৪০ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু স্নাতক পাশ করেন ১২৪ জন। ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের ২০১২-১৩ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ২১০ জন, কিন্তু স্নাতক পাশ করেন ১৩৭ জন। ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ২৫০ জনের মধ্যে স্নাতক পাশ করেন ১৮৩ জন। এছাড়া বিজ্ঞানের অধিকাংশ বিভাগের চিত্র প্রায় একই বলে জানা যায়।

অন্যদিকে, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন বিভাগে নিয়মিত স্নাতক পাশ শিক্ষার্থীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিসংখ্যান বিভাগে ৯০ জনের মধ্যে ৬৩, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে ৫০ জনের ৩৯, ফার্মেসী বিভাগে ৫০ জনের ৩৯, পপুলেশন সায়েন্স এন্ড হিউমেন রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগে ৬০ জনের মধ্যে ৩৪ জন পাশ করেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৮৮ জনের ৭৩, প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ৮০ জনের মধ্যে ৬৮, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ৬০ জনের ৪৫, ক্রপ সায়েন্স বিভাগের ৫৬ জনের ৩৮ এবং এগ্রোনোমী এন্ড এগ্রিকালারাল এক্সটেনশন বিভাগের ৫৬ জনের মধ্যে ৪৬ শিক্ষার্থী স্নাতক পাশ করেন।

বিভিন্ন বিভাগের স্নাতকোত্তরের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমবর্ষেই বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো কিভাবে শেষ করতে হবে তা অনেক শিক্ষার্থীই বুঝতে পারেন না। বিভাগগুলোর সিলেবাস অনেক বড়, এমনকি যুগোপযোগী নয়। উন্নত বিশ্বে অনেক আগেই যেগুলো পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে, এমন অনেক বিষয় এখানে পড়ানো হয়। যার কার্যকারিতা নেই। বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্তঃসম্পর্ক খুব একটা ভালো না হওয়ায় অনেক সময় শিক্ষার্থীরা সঠিক নির্দেশনা পান না। শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যেতেও পারেন না। এছাড়া শিক্ষকদের কঠোরভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নও দায়ী।

বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান খান বলেন, বিভিন্ন কারণে এমন হতে পারে। শিক্ষার্থীরা হয়তো নিয়মিত পড়াশোনা করে না এমনকি ক্লাসেও আসে না। এমনটাও হতে পারে, হয়তো শিক্ষকরা ঠিকমতো পাঠদান করছেন না। বর্তমান শিক্ষার্থীরা নোট-শীট নির্ভর হয়ে পড়ছে। না বুঝে মুখস্থ করে পরীক্ষায় বসছে। ফলে অকৃতকার্য অনেকে পরবর্তী বর্ষে চলে যায়। তিনি স্বীকার করেন, সিলেবাসটাও ভারি, যা শিক্ষার্থীদের জন্য আয়ত্ব করা কষ্টসাধ্য। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতিটি বিভাগকে উদ্যোগ নিতে হবে।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনের কারণ ৩টি। প্রথমত, শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যে পদ্ধতিতে পড়ালেখা করছে, তা মুখস্থ নির্ভর। ওই মানসিকতা নিয়েই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় তাল মেলাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকরা ছাত্রদের মোটিভেট করতে পারছেন না। তৃতীয়ত, শিক্ষকরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বুঝাতে পারছেন না। এছাড়া জ্ঞান ও শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহও কম, অল্প পরিশ্রমে ভালো ফলের আগ্রহ এখন প্রায় সকলের।

রাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত সাজেশনের প্রশ্ন মুখস্থ করে ভালো ফল করে। সংক্ষিপ্ত পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু তাদের ভিতটা শক্তিশালী হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অনেকে সিলেবাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। তিনি বলেন, এখন এমন শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হচ্ছে, যাদের বিজ্ঞানে আগ্রহ কম, নেই এসএসসি ও এইচএসসি-তে শক্তিশালী ভিত। তাদের মধ্যে থেকেই অনেকে শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।


সর্বশেষ সংবাদ