প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ নবীনরা, চান নৈরাজ্যমুক্ত ক্যাম্পাস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে  শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়েছে মাত্র কয়দিন। নতুন ক্যাম্পাস, নতুন বন্ধুবান্ধব, সবই নতুন। এই নতুন পরিবেশে কেমন আছেন নবীনরা— এ নিয়েই তাদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশাগুলো লিখছেন রোকনুজ্জামান

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন মো. মিরাজ হোসেন। পড়ছেন ইতিহাস বিভাগে। পাহাড় ঘেরা ক্যাম্পাস, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড় আবার শাটল ট্রেনের রাজ্য, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অতিমাত্রায় উপভোগ করছি— বললেন মিরাজ।

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসের বড় ভাইয়া ও আপুরা কত হেল্পফুল হয় তা এখানে না আসলে হয়তো বুঝতাম না। ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট, স্টেশন, লেডিস ঝুপড়ি, শহিদ মিনার সব জায়গাতেই তারুণ্যের জয়জয়কার। ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ কথাটা বলতে অনেক বেশি গর্ববোধ করি। এখন প্রত্যাশা একটাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য মুক্ত ও সুষ্ঠু পরিবেশ যেন বজায় থাকে।

সৃষ্টিকর্তার অশেষ ইচ্ছাতে জীবনের অন্যতম বড় সফলতা পেয়েছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে। একজন নতুন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রতিনিয়ত আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানার চেষ্টা করছি— জানালেন লোকপ্রশাসন বিভাগের ফাতেমা তুজ্জোহরা মিতু।

তিনি বলেন, আমি মুগ্ধ হয়েছি আমাদের সমৃদ্ধ পাঠাগার দেখে। এখানে গিয়ে পড়তে ইচ্ছা করবে না এমন মানুষ পাওয়াই হয়তো দুষ্কর। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও এগিয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের একপাশে পাহাড় অন্য পাশে রাস্তা, মাঝে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। এই সৌন্দর্য আসলে লিখে বর্ণনা করার মতো নয়। আমি নবীন শিক্ষার্থী, আমার চোখে এই পুরো ক্যাম্পাসকে ঘিরেই অসম্ভব ভালো লাগা তৈরি হয়ে গিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে স্বপ্নের কোনো কমতি নেই মিতুর। বলেন, আমি স্বপ্ন দেখি— বিতর্ক, নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি, পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য সকল সৃজনশীল কার্যক্রমেও সেরা হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরবো। নিঃসন্দেহে আমার ক্যাম্পাস পুরো বিশ্বের মধ্যে অনন্য। কারণ, বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাস আমাদেরই রয়েছে। আশা করি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় সমগ্র বিশ্বের সামনে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে।

আমি স্বপ্নদ্রষ্টা, আশা করি আমার ক্যাম্পাস বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপদ ক্যাম্পাসে পরিণত হবে। আমার স্বপ্ন আমি এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই নিজেকে দেশের অন্যতম সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব— বললেন মিতু।

পদার্থবিদ্যা বিভাগে পড়ছেন শিক্ষার্থী আরিফ হাসান রিমন। কলেজ জীবনে অনেক বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছে তাকে। ভার্সিটি জীবনে সবকিছু উন্মুক্ত, স্বাধীন। মুক্তি পেয়ে ইতোমধ্যে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করছেন জানিয়ে বলেন, তবে অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত ‘দায়িত্বটা আমারই’। ২ হাজার ১০০ একরের এই মনোরম, স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ ক্যাম্পাসটা সত্যিই অসাধারণ। একজন প্রকৃতি-প্রেমিক হিসেবে আমার কাছে এই পাহাড়ঘেষা ক্যাম্পাস, পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাওয়া রাস্তা, রাস্তার পাশের সুউচ্চ গাছগুলো সত্যিই এক স্বর্গীয় অনুভূতি।

অল্প দিনেই ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়ার কথা উল্লেখ করে রিমন বলেন, সৌন্দর্যের আনন্দদায়ক মুহূর্তের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে শাটল ট্রেন। এটি ছাড়া ক্যাম্পাস লাইফের অর্ধেক চিন্তায় যেন অপূর্ণ থেকে যায়। ভার্সিটি আসার ২দিন পরেই জীবনের প্রথম ট্রেনে উঠি। তাও আমাদেরই শাটলে। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকার অনুভূতিটাই আলাদা। বগির মাঝ থেকে ভেসে আসা বড় ভাইদের গানের সম্মিলিত সুরের সাথে ট্রেনের ঝুকঝুক শব্দ। এ যেন এক শ্বাশত সুন্দরের আনন্দঘন মিলনমেলা।

পদার্থবিদ্যা বিষয়টা আমি অনেক আগে থেকেই অপছন্দ করতাম। তবে হতাশা এখনো আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পদার্থবিদ্যায় খারাপ ছিলাম, আছি। তবে অদূর ভবিষ্যতে আশা করি থাকব না। সময় এসেছে নিজেকে বদলানোর, দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠার। আর একজন শিক্ষার্থী চাইলে সব কিছুই করতে পারে। প্রথম বর্ষের সব সহপাঠীর প্রতি শুভ কামনা রইল— এই বলে শেষ করছেন রিমন।

স্কুল, কলেজ ও বেড়ে ওঠা সবই ছিল গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেই ইচ্ছা শক্তির প্রতিফল এবং আল্লাহর অশেষ কৃপায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্যতম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি— দম না পেলে বলে ফেললেন সানিয়া ইসলাম আন্না। তিনি পড়ছেন ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগে।

আন্না বলেন, শুরুতে পরিবার থেকে চায়নি এতো দূরে গিয়ে পড়ালেখা করি। কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাজিত হয় তাদের অমত। অনেকটা ভয়ভীতি নিয়ে একাই পথ পাড়ি দিই। কিন্তু ক্যাম্পাসে আসার পরই সব ভয়ভীতি দূর হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, বড় ভাই-বোনেরা, সহপাঠীরা এতো হেল্পফুল হবে কল্পনার বাইরে ছিল। আর শিক্ষকদের আন্তরিকতা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে। সব মিলিয়ে মনে হয় আরেকটা পরিবার পেয়েছি। এতো বিশাল ক্যাম্পাস দেখে মনটার প্রশস্ততাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। 

আর পাহাড়ে ঘেরা এই প্রকৃতির মতো নিজেকে উদার করে গড়ে তুলতে পারব এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে মানুষের কল্যাণে প্রকৃতির উদারতার মতো নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারব— আশাবাদী আন্না।

ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মাসুদ পারভেজ বলেন, আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নিজেকেও উন্নতির চরম শেখরে নিয়ে যেতে পারি। আমার প্রত্যাশা, এই বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হোক এবং বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে যাক বিশ্বজুড়ে।

 

 

ফাইন্যান্স বিভাগে পড়ছেন মো. আশিকুর রহমান নিশান। তিনি জানান, প্রায় সব শিক্ষার্থীরই স্বপ্ন থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তবে সেটা যদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হয় তাহলে তো কথায় নেই। প্রথম এসেই এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য ও শাটল ট্রেন আমাকে মুগ্ধ করে। এখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন ছাত্র।

নিজের ভাবনা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শহিদ মিনারের উপর যে আনারসটা আছে সেটা যদি আলোকসজ্জিত করা হয়, তাহলে হয়তো রাতের বেলার শহিদ মিনার আরও সুন্দর লাগবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার জায়গা অনেক। আমি মনে করি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের নাম্বার ওয়ান পজিশনে নিয়ে যাওয়া যাবে।’

নতুন ক্যাম্পাসের ভাবনা ও প্রত্যাশ জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মুনিয়া ইসলাম কতগুলো রোমাঞ্চের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ অনুভূত হতো। কত কিছুই না শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে! যখনই নিজের ইচ্ছেমত কিছু করতে চাইতাম তখনই আব্বু বলতেন, ‘আগে ভার্সিটিতে ওঠো। তারপর মন মতো থেকে। কেউ কিচ্ছু বলবে না।’

মুনিয়া আরও বলেন, আমার প্রিয় শিক্ষক বলেছিলেন— ‘এখন একটু কষ্ট করো। একটা বার পাবলিকে চান্স পেলেই আর কোনো কাজে কোনো বাধা আসবে না।’ অনেকটা পথ পেরোবার পর, বাবা-মায়ের অবর্ণনীয় আত্মত্যাগের পর আজ আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী।

ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট পাবার পরের অনুভূতি কখনো বলে কিংবা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন— তাই সে কথা অব্যক্তই থাক। ভর্তি হওয়ার পর পরিবার ছেড়ে এত দূরে থাকার কথা ভেবেই খুব খারাপ লাগছিলো। তখনও ভাবিনি এখানে আসার পর ক্যাম্পাসটাই আমার পরিবার হয়ে যাবে। নানান জায়গার, নানান মতের মানুষেরা এভাবে এত সহজে পরিবারের মতো এক হয়ে যেতে পারে তা যেন ছিলো কল্পনাতীত। এখানে আসার পর যেমন একঝাক ভালো বন্ধু পেয়েছি, সিনিয়র ভাই-বোনদের ভালোবাসা পেয়েছি, ঠিক তেমনই ভুল কিংবা অন্যায় করার জন্য তাদের শাসনের সম্মুখীনও হয়েছি। পেয়েছি ভুলগুলো শুধরে নিয়ে সঠিক পথে চলার সুযোগ।

মুনিয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যত স্বাধীনতা আর মজা করার সুযোগই পেয়ে থাকি না কেন মনে রাখা উচিত দিনশেষে আমরা সকলেই একটা লক্ষ্য নিয়ে এখানে এসেছি। ক্যাম্পাসে আসার আগে আম্মু বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছ। যাই করো না কেন এই যুদ্ধে জয়ী তোমাকেই হতে হবে।’ ক্যাম্পাসে যেমন স্বপ্ন জয়ের গৌরবময় গল্প আছে তেমনই আছে স্বপ্নভঙ্গের করুণ ইতিহাস। ভালোবাসার এই ক্যাম্পাসে আমরা প্রত্যেকেই যেন সব বাঁধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠে নিজের সফলতার গল্প শোনানোর জন্যে আর নিজের বাবা-মায়ের মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটানোর জন্যে তৈরি হতে পারি সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।


সর্বশেষ সংবাদ