ইডেন কলেজ: এক বছরে ৪ ছাত্রীর বিদায়

  © টিডিসি ফটো

বছর শেষ হতে কয়দিন বাকি। এই বছরকে বিদায় জানাতে গিয়ে মর্মান্তিক বেশ কয়টি ঘটনা ভাসছে ইডেন মহিলা কলেজের স্মৃতিপটে। বছরের শুরুতে সাবেক অধ্যক্ষকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগ। এরপর সারাদেশের মতো ডেঙ্গুর ছোবলে ইডেন হারায় দুই রত্নাকে। ছাত্ররাজনীতিকে আশ্রয় করে নিজেদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষসহ আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নিখোঁজের মতো ঘটনার স্বাক্ষী ২০১৯ সাল। একবছরে চিরবিদায় নেয় চার ছাত্রী।

২০ ভরি স্বর্ণ ও টাকা চুরি করতে সাবেক অধ্যক্ষকে হত্যা: ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার বাসার দুই গৃহপরিচারিকা রুমা ওরফে রেশমা ও রিতা আক্তার ওরফে স্বপনা। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে সুকন্যা টাওয়ারে নিজ বাসা থেকে মাহফুজা চৌধুরী পারভীনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বাসায় থাকা ২০ ভরি স্বর্ণ, একটি স্যামসাং মোবাইল এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা চুরি করতে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।

মামলার অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, আসামি রিমা আক্তার ওরফে স্বপ্না (৩৭) মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে কাজের বুয়া হিসাবে যোগদান করে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মাহফুজা চৌধুরী পারভীনকে নাক মুখে ওড়না পেঁচিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে নগদ টাকা, স্বর্ণলঙ্কার, মোবাইল চুরি করেছেন। প্রমাণ হিসাবে তার হেফাজত থেকে নগদ সাত হাজার টাকা, একটি গোলাপী রংয়ের ভ্যানিটে ব্যাগ, একটি স্বর্ণের চেইন, একটি স্যামসাং জে-৭ মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়েছে।

মোটরসাইকেলে কেড়ে নেয় আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন: দ্রুত কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং উবারের মোটরসাইকেলে উঠেছিলেন ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী আকলিমা আক্তার জুঁই। ২ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসা থেকে ফার্মগেটে যাওয়ার পথে বিজয় সরণি এলাকায় রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। দু’দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানেন জুঁই।

বড় বোন তানজিনা আক্তার ডালিয়া জানান, জুই সব সময় পড়া লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ভবিষ্যতে যে আইন পেশায় জড়িত হওয়ার ইচ্ছা করেছিল। জুঁই চাটখিল সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, চাটখিল মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

দুর্ঘটনার পর জুঁইকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তিনি যে মোটরসাইকেলে উঠেছিলেন, তার চালক মো. সুমন ঢাকা মেডিকেলে আসেন। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, জুঁই তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ছিলেন। বিজয় সরণি মোড় এলাকায় যাওয়ার পর যাত্রীর মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ব্যাগ থেকে সেটি বের করার সময় অসাবধানতায় তিনি পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন।

ছাত্রলীগের মাংস ছাত্রলীগ খায়–বললেন কোপ খাওয়া ইডেন নেত্রী: বহিরাগত এক মেয়েকে ইডেন কলেজের আবাসিক হলে রাখাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় এক ছাত্রলীগ নেত্রীর চাকুর কোপে আরেক নেত্রীর হাত কেটে যায়। এছাড়া ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছেন। ৯ নভেম্বর সকালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে এ ঘটনা ঘটে।

অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেত্রীর নাম মাহবুবা নাসরিন রুপা। তিনি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। আর ভুক্তভোগী ও আহতের নাম সাবিকুন্নাহার তামান্না। তিনি ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য।

কোপ খাওয়া ওই ছাত্রলীগের নেত্রী তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কাক নাকি কাকের মাংস খায় না। কিন্তু ছাত্রলীগের মাংস ছাত্রলীগ খায়। বারবার প্রমাণিত’। তার এই স্ট্যাটাসে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। একজনে মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘কোপায় চাঁদাবাজ আর কোপ খায় বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ’।

ডেঙ্গুর ছোবলে ইডেন হারায় দুই রত্না: চলতি বছর ডেঙ্গুর ব্যাপকতায় আতঙ্কগ্রস্থ ছিল সারাদেশ। আর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন কলেজের দুই ছাত্রী। এর মধ্যে ইভা আক্তার (২৪) নামের ওই ছাত্রী আগস্টে রাজধানীর মুগদা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

ইভা মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইল বানারী ইউনিয়নের খালেক মোল্লার মেয়ে। নদী ভাঙনের কারণে তিনি বাবা-মা ও বড় বোনের সঙ্গে ঢাকার আহম্মদবাদে থাকতেন। ইডেন মহিলা কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন তিনি।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া কলেজের আরেক ছাত্রী ফাতেমো আক্তার শান্তার (২০)। তিনিও আগস্ট মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলাকালে বিদায় নেন। এমনকি শান্তার বাবা মো. শামছুদ্দিন এবং ভাই মো. তানভীর আহমেদ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আগেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শান্তাকে দেখার পর তারা আরো অসুস্থ হয়ে যান। তাদের শারীরিক অসুস্থতার কারণে শান্তার জানাজায়ও অংশ নিতে পারেননি।

কলেজের একাউন্টিং বিভাগের শান্তার বান্ধবী তাকিয়া আক্তার দিয়া দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, ‘শান্তা এমনিতে ওর নামের মতই শান্ত, মিশুক এবং অনেক ভালো একটা মেয়ে ছিলো। ক্লাসে নিয়মিত আসত এবং কারো সাথে কোনো ঝামেলা ছিলো না তার। সবার সাথেই ফ্রেন্ডলি মনোভাব সম্পন্ন সম্পর্ক ছিলো তার। শান্তা অনেক হেল্পফুলও ছিলো।’

তিনি জানান, ‘আমাদের যেহেতু একাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট সেহেতু ম্যাথের ব্যাপারটা তো আছেই। যে কেউ কোনো ম্যাথ না বুঝলে ও সাথে সাথে সেটা পিক তুলে দিয়ে দিতো।সবচেয়ে বড় কথা হলো পাগলিটা কখনো কাউকে বুঝতেই দিতো না যে সে কষ্টে আছে। অসুস্থতার বিষয় শুনে আমরা তাকে কয়েকবার দেখতেও গিয়েছিলাম। কালকে তার মারা যাওয়ার খবর আমাদের অনেক ব্যথিত করেছে।’


প্রেমিককে ভিডিও কল দিয়ে বিদায় মেঘার: ‘আমি বাঁচতে চাইছিলাম কিন্তু মাহিবী আর ওর মা আমারে বাঁচতে দেয় নাই। আমি বারবার মাহিবীর কাছে কুকুরের মতো যাই। আর সেই দিনের পর দিন আমারে পায়ে ঠেলে। আব্বু আমারে মাপ কইরা দিও। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেইকা গেছে। তাই আজকে আমি মইরা গেলাম। আমার ভাইটারে মানুষ বানাইয়ো। যেন আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে।’

মৃত্যুর আগে এই সুইসাইড নোটটি লিখে যান ইডেন মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের অনার্স দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী সায়মা কালাম মেঘা। গত ২১ এপ্রিল বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর কলাবাগানে তার নিজ বাড়িতে এই সুইসাইড নোটটি লিখে বৈদ্যুতিক পাখার সাথে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন ওই শিক্ষার্থী। মেঘার বাড়ি ঝালকাঠি জেলা সদরে। তাঁর বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ ও মা রুবিনা আজাদ।

আত্মহত্যার পর তাৎক্ষণিক তাকে ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গলায় ফাসিঁ দিয়ে আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মেঘার বড় ভাই সম্রাট জানিয়েছেন, মেঘার সাথে ঝালকাঠিতে তাদের স্থানীয় ঝালকাঠি বিএম কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহীবি হাসান নামে এক যুবকের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘদিন যাবত তাদের পরিচয়। মাহীবি হাসান মেঘাকে বিয়ের কথা বলে তার সাথে একাধিকবার শারিরীক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ করেছেন সম্রাট।

তিনি আরও জানান, আত্মহত্যার দিন বিকেল ৫টার দিকে মাহীবির সাথে মেঘার ভিডিও কলে কথা হচ্ছিলো। পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ওইদিন তাদের বিয়ের কথা ছিল। তারা ভিডিও কলে এ বিষয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু এসময় মাহীবি তাকে অস্বীকার করলে ভিডিও কল রেখে দেন মেঘা। পরে তিনি পাখার সাথে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

ট্রেন থেকে নামতে না পেরে নিখোঁজ বিন্দু: ইডেন কলেজ ছাত্রী নাফিসা নেওয়াজ বিন্দু গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরায় খালার বাসায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। কমলাপুর ট্রেনস্টেশন থেকে রাজশাহীগামী ট্রেনে উঠেন বিন্দু। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উত্তরা স্টেশনে নামতে পারেনি তিনি। বিকেলের দিকে নাফিসা তার মাকে শেষ বারের মতো ফোন দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেন ‘মা আমি উত্তরা স্টেশন মিস করে ফেলছি। এখন ট্রেন কোথায় আছে জায়গাটা চিনতে পারছি না। পরের স্টেশন এলে নেমে বাস ধরে যাবো।’

এরপর আবার ফোন করে মাকে নাফিসা বলেন মা আমি গাজীপুরের দিকে আছি (ট্রেনে)। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাফিসার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার মার। এরপর অনেকবার ফোন করলে নাফিসার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ নিয়ে যাত্রাবাড়ি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে। পরে অবশ্য বিন্দুকে উদ্ধার করে পুলিশ। বিন্দুর নিখোঁজ নিয়েও নানা মুখরোচক গল্প বানিয়ে ফেইসবুকে প্রচার করা হয়, যদিও এসবেসর সত্যতা মেলেনি।

যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ গণমাধ্যমকে জানায়, ‘ইডেনের ওই ছাত্রী বিন্দু মায়ের সঙ্গে রাগ করে বান্ধবীর বাসায় ছিল। পরে আমরা বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে তাকে আজ বৃহস্পতিবার ভোরে উদ্ধার করি। বর্তমানে সেই ছাত্রীটি সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছে।’ পুলিশ বলেন, ঢাকা থেকে গাজীপুরে খালার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে সেখানে পৌঁছান ওই ছাত্রী। পরে খালার বাসায় না গিয়ে সেখান থেকে মোবাইল ফোন হারিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরে তার বান্ধবীর বাসায় ছিল। সেখান থেকে আমরা তাকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছি।


সর্বশেষ সংবাদ