‘দয়া করে ২৪ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করেন’

জাবি উপাচার্যকে কমরেড খালেকুজ্জামান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাকে অপসারণের দাবিতে আয়োজত এক সংহতি সমাবেশে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান উপাচার্যের প্রতি অনুরোধ করে বলেন,‘আপনি দয়া করে ২৪ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করেন।’

দুদিনের বিরতি শেষে গতকাল মঙ্গলবার ‘ব্যঙ্গ পটচিত্র’ প্রদর্শনী, প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, সংহতি সমাবেশ এবং গানে গানে সংহতির মাধ্যমে আবারো আন্দোলন শুরু করেছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগরে’র ব্যানারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ।

বিকেল চারটায় সংহতি সমাবেশের শুরুতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন বিশিষ্টজনেরা। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উপাচার্যকেই দায়ী করে তার অপসারণ চেয়ে বক্তব্য রাখেন।

সমাবেশে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন,‘মিডিয়া মারফত জেনেছি উপাচার্যের কাছে ছাত্রলীগ কমিশন হিসেবে ৮৬ কোটি টাকা দাবি করেছে। যেখানে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনার জন্য বাজেট মাত্র ৪ কোটি টাকা। আমি উপাচার্যকে অনুরোধ করি দয়া করে আপনি আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যেই পদত্যাগ করবেন। এব্যাপারে আমি সরকার ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রনাল কে ব্যবস্থা নিতে। না হলে আমি হুশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই সংগ্রামের চেতনা এখনো শেষ হয়ে যাইনি এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’

আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন,‘বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যে দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার এর জন্য দায়ী প্রথমত বর্তমান উপাচার্যরা এবং সরকার। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব চলেনা। এখানে আচার্য অফিসের দায়িত্বশীল আচারণ প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা আজ সিনেটরদের দ্বার নির্বাচিত নয়। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। সবাই উপর মহলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে ৭৩ এর অধ্যাদেশে উল্লেখিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন শুধু কাগজে কলমে টিকে আছে। বাদবাকি সবক্ষেত্রে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।’

জাবির আন্দোলন সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি বলেন,‘প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য দুর্নীতিবাজদের উৎসাহ প্রদান করবে। তিনি বলেছেন যখন কোন জায়গাই উন্নয়নে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তখনই টাকা ভাগবাটোয়রার জন্য যখন তখন যেখানে সেখানে আন্দোলন গড়ে উঠে। আমি বলতে চাই তার সঠিক তদন্ত না করে সরকার কেনো ভাগবাটোয়রা ধামাচাপা দিতে চাই। অভিযোগের সাথে সাথে কেনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। আর বাংলাদেশে সাধারণত দুর্নীতি টাকা ছাড়ের পরে নয় বরং আগে হয়ে থাকে। প্রকল্প পাসের সময়, পরিকল্পনায়, টেন্ডারিং এবং বাস্তবায়নের সময়। এখন জাহাঙ্গীরনগর নিয়ে দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। একটি উপাচার্যের দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এবং আরেকটি আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে। আমি বলতে চাই প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে তদন্ত প্রভাবিত হবে এইজন্য স্বাধীনভাবে ও শক্তিশালী মেরুদন্ডের নিরেপক্ষ মানুষ নিয়ে দুইটি তদন্ত কমিটি করতে হবে’।

জাবির আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন,‘ছাত্রলীগ শুধু জাহাঙ্গীনগরের শিক্ষার্থীদের উপরই হামলা চালাচ্ছে না। ছাত্রলীগের হামলা সারাদেশেই চলছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছাত্রলীগের পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সকল ঘটনাতেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনাই তা প্রমান করে। আমরা দেখেছি ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলায় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ লাগে। তাহলে বিচার বিভাগের কাজ কি? বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন হলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়। তাহলে ইউজিসি, শিক্ষামন্ত্রনালয় কি করে? আর যখনই কোন আন্দোলন হচ্ছে তখনই সেখানে বিএনপি জামাতের তকমা দিচ্ছেন।’

উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরো বলেন,‘নিজের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঠেকাতে আপনি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করেছেন। আপনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে তাদের দাবি শুনে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। আপনার বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যই প্রমান করে আপনি দুর্নীতিবাজ।’

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন,‘যে বেহায়া তার হারানোর কিছু নেই। এই বেহায়া উপাচর্যের হারানোর কিছু নেই। সে শুধু উপাচার্য পদ থেকে লুটবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুর্খের শাসন দূর করতে হবে, মূর্খদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত করতে হবে।’

বংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা কমরেড শাহ আল বলেন,‘আপনাদের দাবি ন্যায়ের দাবি, গণতন্ত্রের দাবি। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সংহতি জানায়। আজ ছাত্র-রাজনীতির হিমালয় তুল্য ঐতিহ্য ভুলন্ঠিত হয়ে গেছে। ৫২ থেকে ৭১ এর গৌরবময় ইতিহাস সম্ভব হয়েছিলো ছাত্রদের তারুন্য দ্বারা। আজ কোথায় সেই তারুন্য। আমরা দেখেছি এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রুখে দাড়িয়েছে। আপনারা এই ভিসিকেও উৎখাত করতে পারবেন। দেশ ও জাতিকে আজ স্ট্রিট মাফিয়া এবং স্টেট মাফিয়েদের হতে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদের ডীন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাকে উপাচার্য গণঅভ্যুত্থান বলেছেন। তার এ বক্তব্যে নতুন প্রজন্ম ভাবতে পারে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এমন ছিল। এর ফলে তারা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে ঘৃনা করবে। কিন্তুু ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর এই গণঅভ্যুত্থান এক নয়। তিনি শব্দচয়নে ভ‚ল করেছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু তা করবেন না। তিনি ছাত্রলীগের হামলাকে গণঅভ্যুত্থান বলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অবমাননা করেছেন।’

আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার শাহদিন মালিক, ঢাবির অধ্যাপক গীতি আর নাসরিন, রাষ্ট্রচিন্তার রাখাল রাহা, ঢাবির অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স, কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সম্পাদক লিটন নন্দী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায়, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সভাপতি মাসুদ রানা, জাবি সিনেট সদস্য মোহাব্বত হোসেন খান, সিপিবি এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, বাসদের (মার্ক্সবাদী) বর্ধিত কমিটির সদস্য আ ক ম জহিরুল ইসলামসহ প্রমুখ দেশবরণ্য জাতীয় ব্যক্তিবর্গ।

আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন । পরে বেলা ১১টার দিকে দীর্ঘ ৬০ গজ কাপড়ে আঁকা বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক লেখনি ও চিত্রের প্রদর্শনী করেন আন্দোলনকারীরা। এরপর দুপুর ১২টায় প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন এবং ভবন থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দেন।
পরবর্তীতে বিকেল চারটায় প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংহতি সমাবেশ ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গানে গানে সংহতি নামে একটি প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

এর আগে গত শনিবার আন্দোলনের মুখপাত্র অধ্যাপক রায়হান রাইন বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশবাসীর প্রতি একাত্মতা ও সহমর্মীতা জানিয়ে দুদিনের জন্য আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিতের ঘোষণা দেন।


সর্বশেষ সংবাদ