চবির ভর্তি পরীক্ষার নিয়মে অসন্তোষ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের

  © টিডিসি ফটো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম নিয়ে বিতর্ক উঠেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে পরীক্ষার হলে থাকা নিয়ে অসন্তোষ তাদের। পরীক্ষার হলে ঢোকার পর থেকে প্রায় ২ ঘণ্টা থাকতে হয়ে সেখানে। এমনকি এ সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিক প্রয়োজনের মতো গুরুতর সমস্যাও সারতে দেয়া হয়না বলে অভিযোগ। ভর্তি জালিয়াতি রোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিদ্যমান এ নিয়ম নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও অভিভাবকরা।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ভর্তি পরীক্ষার নিয়মগুলো মধ্যে রয়েছে পরীক্ষার ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট আগে হলে প্রবেশ করতে হবে। নির্দিষ্ট রুম, সিট খুঁজে পেতে লাগে ১৫ মিনিট। এরপর ১৫ মিনিটের মধ্যে কোনো প্রয়োজন থাকলে সেরে আসতে বলা হয়। পৌনে ১ ঘণ্টা পূর্বেই দেয়া হয় ওএমআর পেপার। এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের আর বাহিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। সেটা প্রাকৃতিক প্রয়োজন কিংবা যত গুরুতরই হোক না কেন। চলতি বছরও এই নিয়ম বলবৎ থাকবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

এবছর সকাল ১১টায় পরীক্ষা শুরু হবে। হলে ঢুকতে হবে ৯টা ৪৫ মিনিটে। ওএমআর দেয়া হবে ১০ টা ১৫ মিনিটে। ২০১৮-১৯ সেশন থেকে ১৫ মিনিট কমিয়ে পৌনে ১ ঘণ্টা আগে ঢোকার নিয়ম করা হয়েছে। কিন্তু এর আগে ছিলো দেড় ঘণ্টা পূর্বে ঢোকার নিয়ম এবং ১ ঘণ্টা আগে ওএমআর দেয়া হতো।

জানা গেছে, কতৃপক্ষের ভাষ্যমতে জালিয়াতি রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতার জন্যই করা হয়েছে এই নিয়ম। কিন্তু গত বছর থেকে নিজেদের তৈরি বাংলাদেশে একমাত্র ‘এন্টি প্রক্সি অ্যাপস’ ব্যবহারকারী বিশ্ববিদ্যালয় চবি। যার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে ভর্তি জালিয়াতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু এতকিছুর পরও একজন শিক্ষার্থীকে পৌনে ২ ঘণ্টা বের হওয়ার সুযোগ না দেওয়াটা অযৌক্তিক বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।

পরীক্ষার হলে ২ ঘণ্টা আটকে থাকা এক সাবেক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এবং এ নিয়মে ভুক্তভোগী জানান তার দুর্বিষহ যন্ত্রণার কথা। অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ার আশঙ্কায় না প্রকাশ না করার শর্তে নিজের দুভোগের বর্ণনা দিয়ে ওই শিক্ষার্থী দ্য ডিইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, “২০১৭-১৮ সেশনে আমি চবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বি ও ডি ইউনিটের পরীক্ষায় আমি অংশগ্রহণ করি। প্রথমদিন ডি ইউনিটের পরীক্ষা ছিলো। আমাদেরকে সকাল সাড়ে ৯টায় পরীক্ষার হলে ঢোকানো হয়েছিলো। এরপর ঢোকার সাথে সাথেই স্যাররা বলেছিলো কারো কোনো প্রয়োজন থাকলে সেরে আসতে। আমি তখন তেমন কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি। আধা ঘণ্টা পর ১০ টায় আমাদেরকে ওএমআর সিট দেয়া হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ায় খুব অল্প সময়ে ফরম পূরণ করি।

১০টা ১৫ মিনিটের দিকে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম প্রশ্ন কখন দেয়া হবে? স্যার যখন বললো ১১ টায়, তখন টয়লেটে যাওয়ার জন্য দুই মিনিটের ছুটি চাইলাম। স্যার বললো, পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আর বের হওয়ার সুযোগ নেই। আরও ১৫ মিনিট চলে গেলো। মানসিক প্রেসারে আমার প্রয়োজনটা আরও বাড়ছিলো। কিন্তু স্যার তাও ছুটি দিচ্ছিলো না। এদিকে একাধিকবার ছুটি চাওয়ায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা পাচ্ছিলাম খুব। তবে আমি অনুমান করতে পারছিলাম যে, ছুটি না দিলে হয়তো আজ আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। তারপর পরীক্ষার ১৫ মিনিট আগেও নিজের সর্বোচ্চ আকুতি জানিয়েছিলাম। কিন্তু এবার স্যার খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই বলেছিলো, বেশি প্রয়োজন হলে চলে যেতে পারো। লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী আছে। তোমার মত দু’একজন পরীক্ষা না দিলে কিছু হবে না। এসব শুনে খুব হতাশ হয়ে পড়ি।

এরপর পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। আমি একটা প্রশ্নের জন্য ১০-১৫ সেকেন্ডের বেশি নিতে পারছিলাম না। কোনোমতে বাংলার উত্তরগুলো দিয়েছিলাম। সাধারণ জ্ঞানের উত্তরও দ্রুত শেষ করেছিলাম। এরপর চোখ পানিতে টলমল করছিলাে, এমতাবস্থায় স্যারের কাছে ২ মিনিটের ছুটি চাইলাম। আমাকে আবারও বলা হলো সমস্যা হলে চলে যেতে। বসে পড়লাম। বাকী আছে ইংরেজি ও বিশ্লেষণ দক্ষতামূলক প্রশ্ন। এরমধ্যে বিশ্লেষণ দক্ষতা প্রশ্নগুলো অনেকটা ধাঁধার মতো। একটু ভেবে চিন্তে দিতে হয়। সেই ২০ টা প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব তাড়াহুড়ো করার পরেও ১০ মিনিট সময় লেগে যায়। তখনো পরীক্ষার আধঘণ্টা বাকি। আমি শেষবারের মতো স্যারের কাছে ছুটি চাইলাম। এরপর ছুটি না পেয়ে বসেছিলাম ঠিক, কিন্তু একমিনিট পর উঠে গেলাম। সবার সামনে লজ্জিত হওয়ার আগে নিজের কাগজটা রেখে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলাম। আমার প্রতি, আমার স্বপ্নের প্রতি ওই শিক্ষিত মানুষগুলোর এতটুকু মায়া দেখিনি আমি। অথচ সেদিন দুই মিনিটের ছুটির জন্য আমাকে যত কঠিন শর্তই দেয়া হতো না কেন, আমি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমার স্বপ্ন ছিলো আইন বিভাগে পড়বো। কিন্তু স্বপ্নের খুব কাছে গিয়েও নিয়মের কাছে হেরে গেলাম। সাথে একরাশ লজ্জা ছিলো আমার প্রাপ্তি।

সেদিন শাটলট্রেনে হাজারো শিক্ষার্থীর ভিড়ে আমিও ছিলাম। সবাই এই প্রশ্ন ওই প্রশ্ন নিয়ে কথা বলছিলো। কেউ বন্ধু সাথে নিজের পাশে বসা মেয়েটাকে নিয়ে মন্তব্য করে হাসছিলো। কিন্তু আমার সাথে যা ঘটেছিলো সেটা কারো কাছে শেয়ার করতে পারিনি। পরদিন অবশ্য বি ইউনিটের পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে সেই লজ্জা, আর দুঃস্বপ্নের মত একটা ঘটনা হয়তো কখনো ভুলতে পারবো না।”

সাদিকের মত এমন দুঃস্বপ্নের শিকার হয়তো প্রতিবছর অনেকেই হয়েছেন। কেউবা লজ্জায় আবার কেউ প্রয়োজনে খাতা জমা দিতে বাধ্য হন। সাথে চাপা দিয়ে যান নিজের স্বপ্নের কোনো ইউনিট, পছন্দেন কোনো বিষয়ে পড়ার স্বপ্ন। এসব হৃদয়বিদারক ঘটনা কেউই হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারে না। কিন্তু নিয়মের কাছে হেরে যাওয়া এই শিক্ষার্থীদের মনে আদৌও কি কোনো উচ্চশিক্ষা বা শিক্ষিতের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মাবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরীক্ষার্থীদের অনেক সময় নতুন পরিবেশে, নানা কারণে অনেক সমস্যা থাকে। তাই হলে ঢোকার সময় অনেক কিছু মাথায় থাকেনা। আর যেহেতু পরীক্ষার ঘণ্টা খানেক আগে হলে ঢোকানো হয়। তাই অন্ততপক্ষে প্রশ্ন দেওয়ার আগ পর্যন্ত ছাত্রদের ইমার্জেন্সি প্রয়োজনে টয়লেটে যাওয়ার সুযোগ দেয়া উচিৎ।

ভুক্তভোগীদের সাথে বললে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কতৃপক্ষ শুধু নিয়মের দিকেই তাকায়। একজন শিক্ষার্থীর এখান পর্যন্ত আসা এবং এর পেছনের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটির প্রধান চবির একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার এস এম আকবর হোসাইন বলেন, নিয়মানুযায়ী সবাই সময় মতো প্রবেশ করতে হবে। ওএমআর দেয়ার পরে সুষ্ঠু পরীক্ষার স্বার্থে আর কোনো বের হওয়ার সুযোগ নেই। যত প্রয়োজনই থাকুক না কেন। কারও প্রয়োজন থাকলে এর আগেই সেরে নিতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ