অপহরণ মামলার আসামী চবি মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি!

  © টিডিসি ফটো

গত ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের অনুমোদন দিয়েছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক মো. আল মামুনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে অনুমোদিত ৬ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে সভাপতি হিসাবে মনোনীত হয়েছেন চবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের ছাত্র শরীফ উদ্দীন।

অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিজেও একজন হত্যা মামলার আসামী।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মনোনীত সভাপতি ও ছাত্রলীগ নেতা শরীফ উদ্দিন চবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত সাবেক শিক্ষার্থী এমদাদুল হককে অপহরণ, নির্যাতন, টাকা ছিনতাই ও হত্যাচেষ্টায় দায়েরকৃত মাললার ৭ নম্বর আসামি।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে পিবিআই থেকে তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল হোসেনের জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে মামলার ৭ জন আসামীর মধ্যে ৬ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছেন শরীফ উদ্দিনও।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৬৪ জন। ওই মৌখিক পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হলেও এমদাদুল হক মৌখিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী তাঁকে ‘অপহরণ’ করে নিয়ে যান। এরপর আটকে রেখে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন। পরে ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে অবশ্য পুলিশ যাচাই-বাছাই করে তাঁকে ছেড়ে দেন। ততক্ষণে মৌখিক পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে যায়।

এরপর পুনরায় মৌখিক পরীক্ষা নিতে গত ৩০ মার্চ উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন এমদাদুল হক। তবে এতে কোনো ফল না পেয়ে এমদাদুল হক আদালতে রিট করেন। এরপর থেকে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই দুই পদে এখন পর্যন্ত নিয়োগ স্থগিত রয়েছে। এছাড়া এই পদে পুনরায় মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো এমদাদুল হককে। যদিও স্থায়ী উপাচার্য না থাকায় এখনো ঝুলে আছে এই পরীক্ষা।

এ ঘটনায় গত ৫ই মে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার কতৃক প্রেরিত এক পত্রে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি জানানো হয়। এতে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর প্রণব মিত্র চৌধুরীকে প্রধান ও সাবেক সহকারী প্রক্টর হেলাল উদ্দিন ও মিজানুর রহমানকে সদস্য করা হয়। তবে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটির জমা দেয়া প্রতিবেদনে মামলার প্রথম ৩ আসামী আনোয়ার হোসেন, আসিফ মাহমুদ শুভ ও মোকসেদ আলী ওরফে মীলু প্রামাণিককে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত দেখানো হয়েছে। এছাড়া শরীফ উদ্দিন সহ জাহিদুল হাসান, রফিকুল ইসলাম, ও আসির উদ্দিনের নাম বাদ দেয়া হয়। জানা যায় দোষী সাব্যস্তকারী ৩ জনই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। অথচ বাকী ৪ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত।

স্বর্ণপদক বিজয়ী এমদাদুল হক

এমদাদুল হকের ভাষ্যমতে, উক্ত তদন্ত কমিটি তদন্তের জন্য তার কোনো বক্তব্য নেয়নি। এরপর এমদাদুল হক আবারও সুষ্ঠু তদন্তের জন্য চিঠি দিলে কতৃপক্ষ আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবু নোমানকে প্রধান ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামকে সদস্য করে দুই সদস্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে। সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই এমদাদুল হকের বক্তব্য শোনেন এবং অভিযোগপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন এই তদন্ত কমিটি। অভিযোগ পত্রে জমা দিলেও এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি এই কমিটি।

এদিকে বাদী পক্ষের আইনজীবী চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতের এডভোকেট মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, পিবিআই এর তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ৭ জনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম নামের একজনকে বাদ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমরা এতে নারাজি দিলে কোর্ট ৭ জনের অভিযোগ আমলে নিয়ে সবাইকে তলব করেছে। তাছাড়া পিবিআইর রিপোর্টে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে।

এমদাদুল হক বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক সংগঠনটি অপহরণ, মারধর, টাকা ছিনতাই এবং হত্যাচেষ্টার দায়ে একজন অভিযুক্তকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতির পদ প্রদানের মাধ্যমে একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যদি একজন অপরাধীকে এভাবে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তাহলে অপরাধীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণকারী সংগঠনটিকে বিতর্কের মুখে পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারকদের প্রতি আমার আহ্বান, তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সভাপতির পদ থেকে অপসরণ পূর্বক তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু এ প্রসঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ থেকে কমিটি দেয়ার বিষয়ে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। কাজেই বিষয়টি আমাদের অজান্তেই হয়েছে। তবে অভিযুক্তদের নিয়ে কমিটি গঠন না করাই ভালো। এতে করে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

অভিযুক্ত শরীফ উদ্দিন বলেন, এটা একটি অভিযোগ মাত্র। এখনো কোনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই আমার সম্পৃক্ততা না থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। আমি সেখানে চ্যালেঞ্জ করে বলেছি, যে আমার সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারলে আমি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবো। তিনি বলেন, আমি এমদাদকে চিনতাম না তখন। তাহলে আমি কিভাবে তাকে শিবির আখ্যায়িত করে অপহরণ করি। তাছাড়া তাকে যেমন শিবির বলা হয়েছে, কিন্তু ছাত্রলীগ বিষয়টি প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত সে যেমন শিবির না তেমনি অপহরণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে কেন আসামি বলা হবে?

তবে শরীফের এমন মন্তব্যকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে এমদাদুল হক বলেন, ১ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে “নিয়োগ আটকাতে স্বর্ণপদক পাওয়া প্রার্থীকে অপহরণ” শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টে শরীফ উদ্দিনকে মারধরের বিষয়টির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে দেখা যায়।

অপহরণ মামলার আসাসি ছাত্রলীগের কর্মসূচীতে: এদিকে অপহরণ মামলার ৪ নম্বর আসামি জাহিদুল হাসানের নামে গত ১০ অক্টোবর চবি ছাত্রলীগ কর্তৃক আয়োজিত আবরার ফাহাদ হত্যার শোকর‍্যালীতে অংশগ্রহণের অভিযোগ তুলেছে এমদাদুল হক। তার মতে, অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত একজন অপরাধী কি করে ছাত্রলীগের শোকর্যালীতে অংশগ্রহণ করে তা ভাবনার বিষয়। জাহিদুল হাসান নিজের অপকর্মকে ঢাকার জন্য অথবা অপরাধের দায় থেকে নিজেকে বাচানোর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করছে। এই অংশগ্রহণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এমদাদুল হক।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতকে সিজিপিএ ৪.০০-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৮৮ এবং স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ৯৬ পেয়েছিলেন এমদাদুল হক। দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছিলেন তিনি। কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন এমদাদুল হক।


সর্বশেষ সংবাদ