সংঘর্ষ বাঁধলেই ছুটে আসেন প্রক্টরিয়াল বডি, দায়সারা হল প্রশাসন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

দীর্ঘদিন ইসলামী ছাত্র শিবিরের দখলে ছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। ২০১৪-১৫ সালের দিকে পুরো ক্যাম্পাস দখলে নেয় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে শিবিরের মত ছাত্রলীগেরও চলছে একচ্ছত্র আধিপত্য। যদিও ক্যাম্পাসজুড়ে কোনো প্রতিপক্ষ না থাকলেও থেমে নেই সংঘর্ষ। গ্রুপিং রাজনীতির ফলে সংঘর্ষ এখন নিত্যনৈমিত্তক ঘটনা।

ছাত্রদের অধিকাংশ হলেই কিছুদিন পরপর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে সংঘর্ষের ঘটনা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে এমন সংঘাত প্রবণ ক্যাম্পাসের সকল সমস্যা মিটমাটের জন্য প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিকে। হল প্রশাসন কিংবা হলের দায়িত্বে থাকা কোনো শিক্ষককেই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না।

হল প্রশাসনের এমন ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন এবং ক্ষোভ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। তাই শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলছেন " পরীক্ষা এলে ফর্ম আর এলটমেন্টের আবেদনপত্রে সাইন করাই হল প্রভোস্টের দায়িত্ব। এছাড়া আর কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না।" এদিকে সংঘর্ষের রীতি অব্যাহত থাকায় হলে এলটমেন্ট থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী থাকেন হলের বাহিরে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

এলটমেন্ট থাকা সত্ত্বেও হলে উঠতে পারছেন না, নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, রাজনীতির ভিত্তিতে হলের সীটগুলো দখল করা হয়। প্রতিটি হলের প্রতিটি ব্লক কোনো না কোনো গ্রুপের দখলে। তাছাড়া হলে উঠতেই রাজনৈতিক রেফারেন্সটা এলটমেন্টের চেয়ে বেশি জরুরী এখানে। তাই এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা এলটমেন্ট নিয়ে দিনের পর দিন ঘুরছে। শুধুমাত্র রাজনীতি না করায় কটেজ বা মেসে টাকা দিয়ে থাকছে। কিন্তু হল কতৃপক্ষের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় সংঘর্ষের কবলে পড়ে প্রতিবন্ধীদের কক্ষ। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী চবির সোহরাওয়ার্দী হলের বেশ কয়েকটি কক্ষ ভাংচুর হয় বিজয়ের সাথে সিএফসি গ্রুপের সংঘর্ষকালে। এ সময় প্রতিবন্ধীদের ২১৬ এবং ২১৭ নং কক্ষ ভাংচুর করা হয়। এতে শুকুর আলম এবং অভি নামে দুই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আহত হন। এসময় তাদের একটি ল্যাপটপ এবং বেশকিছু টাকা কে বা কারা লুটপাট করে। পরবর্তীতে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছিলো চবি প্রতিবন্ধী ছাত্রসমাজ।

চবি প্রতিবন্ধী ছাত্রসমাজের অর্থ সম্পাদক ও সোহরাওয়ার্দী হলের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী প্রশান্ত চন্দ্র দাস বলেন, সংঘর্ষের ফলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতিটা অনেকক্ষেত্রে বেশি হয়। কারন আমরা চোখে দেখি না। সামনে থেকে কোনো কিছু নিয়ে গেলেও আমরা সেটা বুঝতে পারি না। চলতি বছরে ২৮ ফেব্রুয়ারির ঐ ঘটনাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

তিনি আরও বলেন, যদিও আমরা নিজ দায়িত্বে 'প্রতিবন্ধী কক্ষ' লিখে রাখি দরজায়। কিন্তু এই দায়িত্ব যদি হল প্রশাসন নেন তাহলে অনেকে উপকৃত হতো। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের কক্ষগুলোর আশেপাশের দেয়ালে থাকা রাজনৈতিক সীলগুলো মুছে দিলে কিছুটা নিরাপত্তা বাড়বে। তাছাড়া সংঘর্ষ বাঁধলে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। তাই প্রক্টরিয়াল বডির অপেক্ষা না করে হল প্রশাসন যদি এই দায়িত্ব নেন, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন হলের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, হল প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছেন তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথাই ভাবেন। কোনো সংঘর্ষেই তাদেরকে এগিয়ে আসতে দেখিনা। ফলে সংঘর্ষ বাঁধলে প্রক্টরিয়াল বডির অপেক্ষায় থাকি আমরা। এমন ভূমিকা পালন করলে হলের দায়িত্ব না নিলেই পারেন তারা।

তাছাড়া হলের টিউটরের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের দায়িত্ব আসলে কি, সেটাই আজ পর্যন্ত জানা হয়নি। শিক্ষার্থীদের কোন সমস্যা নিয়ে এই শিক্ষকদেরকে কাজ করতে দেখেনি কখনো। তাছাড়া হল প্রভোস্টের কাজ বলতে যা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কাজপত্রে আর হলের এলটমেন্টে সাইন করা।'

সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী রেদওয়ানুল জান্নাত বলেন, ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা সোহরাওয়ার্দী হল থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হই। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকির কারনে এরপরে ৬/৭ মাস আর হলে ঢুকতে পারিনি। সর্বশেষ গত মাসে একবার ঢুকেছিলাম সেই হলে। কিন্তু কাগজপত্র থেকে শুরু করে কোনো কিছুই আর পাইনি। এমনকি সেখানে থাকতেও পারিনি। বিজয় গ্রুপের দখলে কয়েকটি ব্লক রয়েছে। তারা এসে ঝামেলা শুরু করেছিলো। অথচ রাজনীতি করলেও আমরা সেখানকার বৈধ এলটমেন্ট প্রাপ্ত শিক্ষার্থী। এরকম শত শত শিক্ষার্থী আছে। যারা বৈধ এলটমেন্ট থাকা সত্ত্বেও কক্ষ ছেড়ে অন্যত্রে গিয়ে কোনোমতে মাথা গুঁজেছে।

এদিকে হল প্রশাসনের সক্রিয় অবস্থান না থাকার দরুন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যমকর্মিরাও সংঘর্ষ কিংবা যেকোনো সমস্যায় হল প্রভোস্টের তলব না করে প্রক্টরের দ্বারস্থ হতে হয়। যদিও এর কারনটা সত্য এবং যৌক্তিক। এমনকি অনেক সংঘর্ষের আদ্যপ্রান্ত জানেনই না হল প্রশাসন' এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ বশির আহাম্মদ বলেন, হলে যারা থাকেন সবাই এলটমেন্ট প্রাপ্ত। এদেরমধ্যে অনেকে রাজনীতি করে। তবে হলের শিক্ষার্থীদের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।

এ বিষয়ে চবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর প্রণব মিত্র চৌধুরী বলেন, হল প্রশাসনের দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা যদি শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ বাড়ান, তাহলে সমস্যাগুলো খুব সহজে সমাধান করা যাবে বলে মনে হয়। কিন্তু সেই দায়িত্বটা হয়তো পালন করছেন না তারা। ফলে প্রক্টরিয়াল বডিকে অনেক সময় হিমসিম খেতে হয়।


সর্বশেষ সংবাদ