উপাচার্যদের যত বিতর্ক-অনিয়ম

  © টিডিসি ফটো

ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি বা উপাচার্য) হলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী| তিনি তার প্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিভাবক। সর্বোচ্চ এই কর্তা যদি দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন তখন স্বাভাবিক নিয়মে চলে না ওই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তখন আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন আর ব্যাহত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহীর দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিক্ষোভ চলছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে| 

শুধু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়। ছাত্রদের কটুক্তি করে সম্প্রতি আন্দোলনের মুখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হন। অনিয়মের অভিযোগে দ্বিতীয় মেয়াদে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাননি অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান। নিয়মিত অফিস করেন না রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কালিমুল্লাহ। অভিযোগ আছে নিজের লোকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রদান করেন। তারপরও তিনি স্বপদে বহাল আছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে কাকে নিয়োগ দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা সরকার। সম্প্রতি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হয়। অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার অনুসারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামিকেও নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশিষ্টজনরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এর পদটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে তবে সেটা শুধু নৈতিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়, পুরো দেশের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। তারা আরও মনে করেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয় তখন রাজনৈতিক পরিচয়টাই প্রাধান্য দেয়া হয়। ফলে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন।

গত বুধবার রাতে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নিয়োগে দুর্নীতি, ভর্তি দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা কারণে তার পদত্যাগ চান তারা। তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলেও জানান শিক্ষার্থীরা। এদিকে, তাদের আন্দোলনের মধ্যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে ১৬ দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে ফেসবুকের স্ট্যাটাসের জের ধরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে কর্তৃপক্ষ সাময়িক বহিষ্কার করেছে। পরে বিষয়টি নিয়ে ভিসিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় এবং বুধবার তার বহিষ্কার প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ।

উন্নয়ন প্রকল্পে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার ঘটনায় উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ অভিযোগে ছাত্রলীগের দুজন শীর্ষ নেতাকে সরে যেতে হয়েছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আগামী ১ অক্টোবরের মধ্যে তার পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম দেয় আন্দোলনকারীরা। এদিকে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করবেন না জানিয়ে উপাচার্য বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দিলে দায়িত্ব থেকে সরে যাবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানও আলোচিত-সমালোচিত। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তার কাছ থেকে ‘চিরকুটের মাধ্যমে’ ঢাবিতে ভর্তি হয়ে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা। সম্প্রতি বিষয়টি গণমাধ্যমে আসলে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, ভর্তি হওয়া এসব শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিল করে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত উপাচার্য ও বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের পদত্যাগ। বুধবার আন্দোলনকারীরা বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কার্যালয় ঘেরাও করতে গেলে ছাত্রলীগ তাদের উপর চড়াও হয়। হামলায় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। তবে আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কালিমুল্লাহ নিয়মিত ক্যাম্পাসে যান না। তিনি অফিস করেন ঢাকায়। অভিযোগ আছে নিজের লোকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়ার। তারপরও তিনি স্বপদে বহাল আছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাকে নিয়োগ দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা সরকার। বর্তমানে চলতি দায়িত্বে উপাচার্য হিসেবে রয়েছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিন আখতার। সম্প্রতি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হয়। অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার অনুসারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামিকেও নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত আগস্টে ছাত্রদের কটুক্তি করে আন্দোলনের মুখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হন। বর্তমানে ভিসির রুটিন (অতিরিক্ত) দায়িত্ব পালন করছেন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. একেএম মাহবুব হাসান। নিয়োগে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগে দ্বিতীয় মেয়াদে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাননি অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান। গত জুনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ঢাবির অধ্যাপক ড. মো: দিদার-উল আলম নিয়োগ পেয়েছেন।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নীতি মানা হয়না। ফলে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন আর অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। তারা এখন শিক্ষার চেয়ে ব্যবসা বাণিজ্য ভালো বোঝেন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শুধু জাবি নয়, উন্নয়নের টাকা নিয়ে চাঁদাবাজির এমন ঘটনা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ঘটছে। এটি অচিন্ত্যনীয়। শিক্ষার জন্য আন্দোলন করেছে যে জাতি সে জাতির তো কোন অন্যায় করার কথা না| কোন দুর্নীতি করার কথা না। একজন সুশিক্ষিত মানুষ কখনো মিথ্যা বলতে পারে না| সুশিক্ষিত মানুষ দুর্নীতি করতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখছি যিনি দুর্নীতি করছেন তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।


সর্বশেষ সংবাদ