১৫ বছর আগে পরিত্যক্ত ল্যাবে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-ক্লাস

১৫ বছর আগে ২০০৪ সালের দিকে বৃষ্টির পানি জমে বিদ্যুতের সংস্পর্শে জামাল উদ্দিন নামের এক কর্মচারীর মৃত্যু ঘটে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রফেসর ড. মো. শামসুল হক নিউট্রন জেনারেটর ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার  পেছনে বড় কারণ এটি।

মূলত জমে থাকা পানিতে পড়েছিলো বিদ্যুতের তার। ল্যাবের কোনো একটি কাজে খালি পায়ে এসে পানিতে পা দেওয়া মাত্রই তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে কর্মচারী জামাল উদ্দিনের। এরপর ল্যাবটির বাকী কর্মচারীদের চিঠিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী দপ্তর ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু ১৫ বছর পরেও ভবনটিতে পদার্থবিদ্যা সহ  ৪টি বিভাগের ল্যাব কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

চবির বিজ্ঞান অনুষদ পেরিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান অনুষদের কাছে রাস্তার ডান পাশে জরাজীর্ণ এই ভবনটির ভিতরের ভূতুড়ে রূপ দেখা হয়নি অনেকের। কারণ বাহির থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে মানুষের আসা-যাওয়া আছে কি নেই। কিন্তু কৌতূহল মেটাতে দিনের ১২টায় মোবাইলের লাইট জ্বেলে ভেতরে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর একটি কক্ষ থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপর কক্ষটিতে প্রবেশ করলে অনেকগুলো যন্ত্রপাতি আর কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ব্যবহারিক ক্লাস করতে দেখা যায়।

কক্ষের পুরনো যন্ত্রপাতিগুলোর সমাহার দেখে পরিত্যক্ত কোনো যাদুঘর মনে হয়েছিলো। আবু কায়েস নামের একজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এখানেই ৪টি বিভাগের ৮টি ব্যাচ প্রতিনিয়ত ব্যবহারিক ক্লাসগুলো করে। অথচ যেকোনো সময় ভবনটি ধসে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ভবনটির প্রতিটি দেয়ালে বৃষ্টির পানির ছাপ স্পষ্ট। বৃষ্টি হলেই ভাঙ্গা দেয়াল বেয়ে এখানে পানি জমতে থাকে। তাই ল্যাবের যন্ত্রপাতিগুলো ভবনের মাঝখানে রাখা হয়েছে। এছাড়া ভবনের ফেটে যাওয়া কিছু দেয়ালে সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভবনটির চারপাশের ঘন জঙ্গলে সাপের উপদ্রব লক্ষণীয়।

এখানকার কর্মচারীরাও সাপের ভয়ে সাবধানে চলাচলের কথা জানিয়েছেন। ভবনের মধ্যে থাকা পুরোনো দুটো বাথরুমের পানি নিষ্কাশনের সমস্যা রয়েছে। মূলত ভবনটি রাস্তা থেকে নিচে নেমে যাওয়াতে পানি নিষ্কাশনের সমস্যা প্রকট। এছাড়া বিদ্যুৎ এর তারগুলো দেয়াল থেকে খসে  এলোমেলো ভাবে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। এর কারণ হিসেবে কর্মচারীরা বলেন, ভবনের দেয়ালে আর কোনো তার জোড়া দেওয়া সম্ভব নয়।

এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ক্লাস করছেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষের ১২০জন, ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের গড়ে ৭০জন, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের গড়ে ৩০জন এবং সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের গড়ে ৩০ জন শিক্ষার্থী। ফলে সপ্তাহে ৫ দিনই ৪ বিভাগের প্রায় ৪০০জন শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক ক্লাসগুলো আগ-পিছ করে নিয়মিত হচ্ছে ভবনটিতে। এদিকে ল্যাবের কর্মচারীরা অন্যান্য কাজেও যুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়।
ল্যাবের কর্মচারি আগে ৬ জন থাকলেও বর্তমানে ৩ জন দিয়েই ল্যাবটির কার্যক্রম চলছে।

ল্যাবে ক্লাস করতে আসা একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ল্যাবের যন্ত্রপাতিগুলো অনেক পুরোনো। অনেক যন্ত্রে ত্রুটিও রয়েছে। আমরা ব্যবহারিক ক্লাসগুলো করার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অনেক উত্তর মেলাতে পারি না। ফলে ব্যবহারিক কাজটা কতটুকু সঠিক হলো সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় না। তাছাড়া ভবনের ঝুঁকি, বাথরুমের সমস্যা এসব তো আছেই।

জানতে চাইলে এক কর্মচারী বলেন, বাথরুমের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। কারণ, ভবনের তুলনায় রাস্তা উঁচু হয়ে যাওয়াতে ভবনটিতে বরং পানি জমে থাকে অধিকাংশ সময়।

ল্যাবটির সহকারি মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ল্যাবের সমস্যাগুলো দৃশ্যমান। আমরা কর্মচারি, তাই দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি অনেক আগ থেকেই জানেন। তারা যত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে শিক্ষার্থী সহ সকলের জন্যই নিরাপদ।

পদার্থবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দিল আফরোজ বেগম বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট দীর্ঘদিন থেকে এই ভবনের বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলে আসছি। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকি আমরা ইতিপূর্বে তিন সদস্যের একটা কমিটি গঠন করে ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনেও ভবনটি দেখিয়েছি। তারাও ভবনটির বিষয়ে নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েছিলো। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই ল্যাবের কোনো খরচও বহন করা হয় না। বিভাগ থেকেই যাবতীয় খরচ বহন করা হচ্ছে। ভবনটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমরা সেখানে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসগুলো নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিভাগও এখানে তাদের ব্যবহারিক ক্লাসগুলো করে থাকেন।

সর্বশেষ ২০১৬ সালে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামকে প্রধান ও বিভাগের আরও দুইজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাঈনুল হক মিয়াজী ও অধ্যাপক ড. নাসিম হাসানকে সদস্য করে একটি ভবনটির পর্যালোচনা কমিটিও গঠন করা হয়।

পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভবনটি অনেক আগ থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ২০০৬ সালের দিকে কিছুটা সংস্কার করা হলেও ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কায় এরপর আর সংস্কার করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটি সম্পন্ন করবে। এ নিয়ে ঢাকা থেকে  ইঞ্জিনিয়ার এনেও দেখানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী দপ্তরের প্রধান আবু সাঈদ বলেন, ভবনটি সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। চুয়েট থেকে আরও কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারকে দেখিয়ে যাচাই-বাছাই করে কাজটি শুরু করব।


সর্বশেষ সংবাদ