উপাচার্যকে ‘প্লিজড’ না করায় শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল!

অধ্যাপক অহিদুজ্জামান
অধ্যাপক অহিদুজ্জামান  © টিডিসি ফটো

লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার পরও এক নারী প্রার্থীকে ফেল করানোর অভিযোগ উঠেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য, সহকারী অধ্যাপক পদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর ওই নারীকে চাকরির লোভ দেখিয়ে ‘শারীরিক সম্পর্কের’ প্রস্তাব দিয়ে হোটেল ওয়েস্টিনে দেখা করতে বলা হয়। এতে সম্মত না হওয়ায় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার পরও তাঁকে মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়নি। নোবিপ্রবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া এক পত্রে এমন অভিযোগের কথা উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এই বিভাগে একজন সহকারী অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে সহকারী অধ্যাপক পদে ১৪ জন এবং প্রভাষক পদে ৭৫ জন প্রার্থী আবেদন করেন। যার বাছাই বোর্ড ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহকারী অধ্যাপক পদে লিখিত পরীক্ষায় ২৫ নম্বরের মধ্যে ১২ নম্বর পেয়েও নিয়োগ পাননি এক নারী প্রার্থী। নিয়োগ দেওয়া হয় নোবিপ্রবির শাখা কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি পাওয়া উপ-রেজিস্ট্রার আ শ ম শরিফুর রহমানকে। কিন্তু উত্তরপত্রে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৬, যা কাটাছেঁড়া করে দেখানো হয় ১০।

অন্যদিকে ওই নারী প্রার্থীর নম্বর কাটাছেঁড়া করে দেখানো হয় সাড়ে ৭। এর আগে আ শ ম শরিফুর রহমান প্রাণিবিদ্যা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে সবেতনে স্থায়ীভাবে পদায়নের অনুরোধ করে ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর আবেদন করেন; যার আলোকে গত বছরের ২৬ নভেম্বর উপাচার্য তাঁকে সহকারী অধ্যাপক পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেন।

অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, ‘পিএইচডি ডিগ্রিধারী এক নারী প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় নাম্বার কমিয়ে দিয়ে ফেল করানো হয়েছে এবং এই আ. শ. ম. শরীফের কম নাম্বারকে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে যোগ্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ওই নারীকে চাকরির লোভ দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্কের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। সর্বশেষ তাকে হোটেল ওয়েস্টিনে দেখা করার জন্য বলা হয়। এই সম্পর্কিত অডিও-ভিডিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিকারের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, নোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক অহিদুজ্জামানের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি আইয়ুব আলী। লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর আইয়ুব ওই নারী প্রার্থীকে উপাচার্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে বলে। উপাচার্যকে ‘প্লিজড’ করতে পারলে চাকরির নিশ্চয়তা দেয় আইয়ুব। এসব বিষয় কাউকে না বলার চাপও দেয়া ওই নারী প্রার্থীকে।

আরো যত অভিযোগ: তথ্যমতে, অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান ২০১৫ সালের মে মাসে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) উপাচার্য পদে নিয়োগ পান। যোগদান করেন ওই বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে। যোগদানের পর থেকে গত চার বছরে নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন এ উপাচার্য।

অধ্যাপক অহিদুজ্জামান নোবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে যোগ দেয়ার ছয় মাস আগে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ভর্তি কার্যক্রমও তিন মাস আগেই শেষ হয়ে যায়। যদিও অভিযোগ রয়েছে, উপাচার্য পদে যোগদানের পর ছয় মাস আগে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার পারিতোষিক বাবদ ১ লাখ ৫ হাজার টাকা গ্রহণ করেন অহিদুজ্জামান।

অযৌক্তিকভাবে ভর্তি পরীক্ষার টাকা গ্রহণের মাধ্যমে এক ধরনের অনিয়মের মধ্য দিয়েই নোবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে পথচলা শুরু হয় অধ্যাপক অহিদুজ্জামানের। এরপর গত চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সর্বশেষ সভায়ও বেশকিছু পদে বিতর্কিতভাবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে অনিয়মের যাত্রা অনিয়ম দিয়েই শেষ করেন অধ্যাপক অহিদুজ্জামান। ২ জুন উপাচার্য পদে মেয়াদ পূর্ণ হয় তার।

অহিদুজ্জামানের অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ফিরিস্তি তুলে ধরে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বরাবর এক অভিযোগপত্র জমা দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রয়োজনের বেশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া, নিকট আত্মীয়দের নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি, নিয়মবহির্ভূতভাবে বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকে এমনকি বিদেশে অবস্থানকালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার পারিতোষিক গ্রহণ, নিয়মবহির্ভূতভাবে জ্বালানি, টিএ-ডিএ বাবদ অর্থগ্রহণসহ নানা অনিয়মের কথা উঠে এসেছে অভিযোগপত্রে। এ অভিযোগপত্রের সঙ্গে তার বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের প্রমাণস্বরূপ কিছু নথিও সংযুক্ত করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ৩ একর জমির ওপর নির্মিত বাংলোর পুরো সুযোগ-সুবিধা নিলেও যোগদানের পর প্রায় এক বছর দিনপ্রতি এক কক্ষের ভাড়া হিসেবে মাত্র ১০০ টাকা করে পরিশোধ করেছেন উপাচার্য। এছাড়া এতে উপাচার্যের বিরুদ্ধে চেক প্রজাতন্ত্র ও জাপান ভ্রমণের ভুয়া ভাউচার জমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়, সচল গাড়িকে ব্যবহারের অনুপযোগী দেখিয়ে ইউজিসি থেকে নতুন গাড়ি ক্রয়ের অনুমোদন গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি উপাচার্যের স্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করাসহ বেশকিছু আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়।

উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ওই পত্রে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও ইউজিসির প্রজ্ঞাপনকে আমলে না নিয়ে অনুমোদনহীন পদে ১৪ জন শিক্ষক ও ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন অধ্যাপক অহিদুজ্জামান। এছাড়া বাংলাদেশ অ্যান্ড লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ বিভাগে বেসরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত একজন সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন তিনি, যা বাংলাদেশে নজিরবিহীন।

এছাড়া এতে তার বিরুদ্ধে অ্যাডহক বা শিক্ষাছুটির বিপরীতে নিয়োগের বাইরেও অনুমোদনহীন পদে ১৯ জন শিক্ষককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে দু’জন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ দুটি পদে আবেদনের সময়সীমা ছিল ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে আবেদনের ডেডলাইন শেষ হওয়ার আগেই নিজ আশীর্বাদপুষ্ট দুজন শিক্ষককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন উপাচার্য।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে অধ্যাপক অহিদুজ্জামানের ফোনে বেশ কয়েক দফায় ফোন দেওয়া হলেও রিসিভ করেননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে এর আগেও তাকে ফোন দেওয়া হয়েছিল।


সর্বশেষ সংবাদ