একজন অমুসলিম নারীর হিজাব-অভিজ্ঞতা

চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ক্যাথি চিন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর হিজাব পরিধানের অভিজ্ঞতাসংবলিত লেখাটি ‘আল-তালিব’ ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মুসলিম শিক্ষার্থীরা সংবাদভিত্তিক ম্যাগাজিনটি প্রকাশ করে থাকেন। পরে লেখাটি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ‘আইডিয়াল মুসলিমাহ’ থেকে প্রবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন আতাউর রহমান খসরু

আমি সাদা ও লম্বা একটি পোশাক পরে এক বিকেলে রাস্তায় হাঁটছিলাম। বাতাসে কাঁধছোঁয়া কালো চুল দোল খাচ্ছিল। হঠাৎ একদল ট্রাক ড্রাইভার আমাকে দেখে শিস বাজাল, অশ্লীল মন্তব্য করল। আমার সুখানুভূতি বিস্বাদে পরিণত হলো। নিজেকে পরাজিত মনে হলো। এরপর?

আমি মাত্র সেলুন থেকে বের হলাম। খুব ছোট করে চুল কেটেছি। আমি ‘হেয়ার ড্রেসার’কে বলেছিলাম, সে যেন আমার চুলগুলো একজন পুরুষের মতো করে কেটে দেয়। অসাড় হয়ে বসে ছিলাম। হেয়ার ড্রেসার দক্ষতার সঙ্গে কাঁচি চালাচ্ছিল আর সে থামবে কি না বারবার তা জানতে চাইছিল। কিন্তু আমি থামতে বলিনি। যদিও নিজেকে একজন বিকৃত মানুষ বলে মনে হচ্ছিল।
আমি আমার নারীত্ব মুছে ফেলতে চাইছিলাম

এটা শুধু চুল কাটা ছিল না; বরং তার চেয়েও বেশি কিছু ছিল। চুল কেটে আমি উভলিঙ্গের মতো হতে চাইছিলাম। চাইছিলাম আমার নারীত্ব মুছে ফেলতে। এর পরও কিছু পুরুষ আমার সঙ্গে যৌনসামগ্রীসুলভ আচরণ করছিল। আমি ভুলের মধ্যে ছিলাম। সমস্যা আমার নারীত্বে ছিল না, ছিল আমার লিঙ্গ-পরিচয়ে। পুরুষরা আমার ‘বায়োলজিক্যাল সেক্স’ বা শারীরিক যৌনতাকেই গ্রহণ করেছিল। তারা আমার সঙ্গে তেমনই আচরণ করছিল, যেমন তারা আমাকে দেখছিল। বাস্তবে আমি কেমন, সেটা তারা মূল্যায়ন করেনি। তারা কেন আমাকে নিজেদের মতো করে ভাবে? অথচ আমি জানি, আমি কে।

আমি বিশ্বাস করি, যেসব পুরুষ নারীদের শুধু ‘যৌন উপকরণ’ হিসেবে দেখে, তারাই নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে। ধর্ষণ ও শারীরিক হেনস্তা তাদের দ্বারাই হয়। যৌন সহিংসতা ও নিপীড়ন শুধু আমার ভয় নয়, এটি ছিল আমার জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আমি ধর্ষণ ও বলাত্কারের শিকার হয়েছিলাম। আমার প্রতি পুরুষের সহিংস আচরণ একই সঙ্গে আমাকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছিল। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে এই সহিংসতা ও নিপীড়ন থামাব? কী করলে পুরুষ আমাকে নারী হিসেবে দেখবে না? নারীত্ব ও পুরুষের লালসা থেকে আত্মরক্ষার সমীকরণ কিভাবে সম্ভব? ভীতিকর এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমি জীবনকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব? আমার অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের ওপর অসংখ্য প্রশ্ন তোলে আমার অভিজ্ঞতা। আমি কি অন্য ১০ জন চীনা-আমেরিকান নারীর মতো? আমি ভাবতাম, আমাকে আত্মপরিচয় নির্ণয় করতে হবে। কিন্তু উপলব্ধি করলাম, ক্রমেই তা বিকশিত হচ্ছে।

আমার হিজাব পরিধানের অভিজ্ঞতা

একটি শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। আমি একটি ম্যাগাজিনের প্রজেক্টে কাজ করার সময় মুসলিম নারীর পোশাক পরেছিলাম। ক্রিনশো বুলেভার্ডে তিনজন মুসলিম পুরুষের সঙ্গে প্রজেক্টটি করতে হয়েছিল। আমি একটি সাদা ফুলহাতা সুতি শার্ট, জিনস ও ‘টেনিস শু’ পরেছিলাম। প্রিন্টের সিল্ক স্কার্ফে আমার মাথা ঢাকা ছিল। মুখমণ্ডল ছাড়া আমার পুরো শরীর আবৃত ছিল। একজন মুসলিম নারীর কাছ থেকে আমি তা ধার নিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস, এটা শুধু বাহ্যিক বেশ ছিল না; বরং তা আমার অনুভূতিকে স্পর্শ করেছিল। অবশ্য আমি সত্যিই জানতাম না, নারীরা কেন হিজাব পরে? আমি এভাবে বলছি, কারণ বিষয়টি ব্যক্ত করার মতো সঠিক শব্দ আমার জানা নেই। আমি ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে বেড়ে উঠিনি। যাহোক, মানুষ আমাকে মুসলিম নারী মনে করল। তারা আমার সঙ্গে ‘যৌনসামগ্রী’সুলভ আচরণ করল না এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করল না। আমি বুঝতে পারলাম, হিজাব পরলে পুরুষের চোখ আমার শরীর চষে বেড়ায় না।

আমি যখন একটি ইসলামিক সেন্টারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, একজন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আমাকে বোন সম্বোধন করেন। ফেরার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি চীনা বংশোদ্ভূত। চীনা ও আফ্রিকানদের ভেতর অনেক পার্থক্য। তার পরও কেন আমাকে বোন সম্বোধন করল? অবশ্য আচরণে আমাদের ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ পাচ্ছিল, তাই তারা হয়তো ভেবেছে আমি মুসলিম!

হিজাব পরিধান ও পুরুষের আচরণে পরিবর্তন

আফ্রিকান অলংকার ও আসবাব বিক্রি করে—এমন একটি দোকানের সামনে হাঁটার সময়ও একজন জানতে চাইলেন আমি মুসলিম কি না? আমি কী উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকলাম। আমার সঙ্গে থাকা একজন মুসলিম পুরুষকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি মুসলিম? তিনি জবাব দিলেন, পৃথিবীর সব মানুষ ‘উম্মাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর কথায় মনে হলো, আমি মুসলিম হলেও হতে পারি, যদিও আমি নিশ্চিত নই। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, মসজিদে যাওয়া, রোজা রাখা, হিজাব পরা ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে মুসলিম হওয়া-না হওয়ার বাহ্যিক সম্পর্ক নেই। বিষয়টি নির্ভর করে মানুষের বোধ ও বিশ্বাসের ওপর। তবে এটা ঠিক, হিজাব পরার পর আমার সঙ্গে মানুষের আচরণে পরিবর্তন এসেছে। পুরুষের সামনে আমি ভিন্নরূপে, ভিন্ন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছি।

হিজাব পরিধানের সিদ্ধান্ত নিলাম

আমি স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, আমি পুরুষের কাছ থেকে সম্মান প্রত্যাশা করি। প্রাথমিকভাবে, একজন ‘উইমেন স্টাডিজ’-এর শিক্ষিকা ও নারী গবেষক হিসেবে এবং পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি লালন করায় আমি স্কার্ফকে নারীর প্রতি ‘অত্যাচার’ মনে করতাম। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর বুঝতে পারলাম, হিজাবকে অবিচার মনে করা একধরনের বর্ণবাদী আচরণ ও অপপ্রচার মাত্র। এমনটি হতো না, যদি ‘রাষ্ট্রীয় আইন’ (আইন প্রণেতা অর্থে) সত্য জানতে ও বুঝতে প্রত্যয়ী হতো।

আমার জীবনের সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক সিদ্ধান্ত

আমি আমাকে আবৃত করে রাখি, যদিও বিষয়টি আমার খুব পছন্দের নয়, তবে এটা আমার জীবনের সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক সিদ্ধান্ত। এখন পুরুষ আমাকে নারী হিসেবে সম্মান করে। আমি আবিষ্কার করেছি, আমি কেমন পোশাক পরছি তার ওপর নির্ভর করে, অন্যরা (পুরুষ) আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করবে। এটি একটি বাস্তবতা—যা আমি মেনে নিয়েছি। পরাজয়ের বিপরীতে আমি বিজয় বেছে নিয়েছি। হিজাব পরে আমি আমার যৌনতা আড়াল করেছি, নারীত্ব নয়। এই আড়াল পরবর্তী স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়।

 


সর্বশেষ সংবাদ