নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসের গল্প

  © ফাইল ফটো

শিক্ষার্থীদের গল্প, আড্ডা, দুষ্টামি, হাসি, ঘুরে বেড়ানো, দুরন্তপনা, গাণ-বাজনা, খেলাধুলা, ছুটে চলা ইত্যাদি বিভিন্ন সুখময় ঘটনায় প্রাণঞ্চল থাকে প্রতিটি ক্যাম্পাস। আবার, কখনো পারিবারিক, ব্যক্তিগত, আকস্মিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনমরা বন্ধুকে জাগ্রত করতেও ক্যাম্পাসে ঘটে প্রাণের স্পন্দন।

জন্মদিনে উচ্ছ্বাস-উল্লাস, বসন্ত, বন্ধু দিবস, ভালোবাসা দিবস, কনসার্ট ইত্যাদি বিভিন্ন ডে ইভেন্টে মজা-মাস্তিতে ভরপুর থাকে দেশের ক্যাম্পাসগুলো।

দিন আসে দিন যায়, বদলায় তারুণ্য, পুরানো ছেড়ে নতুন আসে, চেনা জায়গা দখলে নেয় অচেনা মুখ তবুও ক্যাম্পাসের চিরচেনা রূপ কখনো পরিবর্তন হয়না। এ যেন একটা জীবন চক্র। শুরু থেকে শেষ আবার শেষ থেকে শুরু। ক্যাম্পাসের এই জীবনচক্রে কতকিছু ঘটে, কতকিছু ঘটার অপেক্ষায় থাকে শুধু মানুষগুলোই পরিবর্তন হয়। কখনো থামেনা ঘটনার প্রবাহ।

এরই ধারাবিকতায় বছরের পর বছর ক্যাম্পাস থাকে প্রাণের প্রণয়ে। কিন্তু, হঠাৎ একটা মারাত্মক ভাইরাস সবকিছু থামিয়ে দিল। থামিয়ে দিল ঘটনা প্রবাহের জীবনচক্র যা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগলো বাস্তবতা আর তার সাথে নিস্তব্ধ হতে লাগলো ক্যাম্পাস।

ঠিক তেমনি একটা নিস্তব্ধ ক্যম্পাসের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী। সাভারের নলামে, বংশী নদীর কোল ঘেসে বেড়ে ওঠা গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিস্তব্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয় শিক্ষার্থীদের পদচারণায় কত মুখর থাকতো এ ক্যাম্পাসটি।

৩৪ একরের সবুজে ঘেরা, নান্দনিক ক্যাম্পাসের নিস্তব্ধতা তুলে ধরে নিরাপত্তা রক্ষী সুমনা সকাল বলেন, এভাবে আর ভালো লাগে না। শিক্ষার্থী ছাড়া ফাঁকা ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করতে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। তাদের পদচারণায় মুখর থাকা ক্যাম্পাসে, তাদের সাথে কথা বলা, সরগম পরিবেশের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করার সময় কখন যে দিন পার হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। এই একটা ভাইরাস সব শেষ করে দিল, খুবই বিরক্ত লাগছে আর সইতে পারছি না।

সুমনা সকালের বিরক্ত যেমন, তেমন বিরক্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাস কেন্দ্রীক সকল মানুষের চোখে-মুখে। ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সের অনুষদের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাব্বি ইবনে কাদের বলেন, ব্রেক টাইমে নানির দোকানে ছুটে যাওয়া আর গল্প, হাসি, দুষ্টুমিতে ভরা জমিয়ে উঠা সময়টাকে বড্ড মিস করছি। ঘুম ঘুম চোখে ভার্সিটিতে এসে গরম গরম পিঠা খাওয়া আর হয়না। কি সুন্দর দিনই না ছিলো। এখন রুমের মধ্যে প্রতিটি দিনই জেলাখানায় মতো। মনে হচ্ছে বিনা কারণে ঘরে বসে বসে শাস্তি পাচ্ছি।

ক্যাম্পাসের এই নিস্তব্ধতার চিত্র লেগে আছে ক্যাম্পসের প্রতিটি অঙ্গনে-

বাদাম তলা: এটা গবির সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা। আড্ডা, মাস্তি, খুনসুটির এক রমরমা স্থান এটি। সকাল থেকে রাত এখানে প্রাণের সমাগমে ঘমঘম যেন শেষই হতে চায় না। এখন জায়গাটা নিস্তদ্ধতায় ভরা।

সরগরম বাদাম তলায় নেই প্রাণের চিহ্ন

পিঠা চত্বর: কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পূর্বকোণে ছোট্ট একটা জায়গায় সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। চলে পিঠা খাওয়ার ধুম আর আড্ডার। ক্যাম্পাসের জনপ্রিয় এই জায়গাটা এখন শূণ্যতায় বন্ধী।

পিঠা চত্বরের এই ভিড় এখন আর নেই

সাংবাদিক সমিতির অফিসের বারান্দা: এটি এমন এক জায়গা যেখানে গাণ-বাজনা চলে, আবার গ্রুপ স্টাডির ধুমও চলে। চলে আড্ডা-মাস্তি আবার অবকাশ যাপনও। প্রেমিক-প্রেমিকাদের একসাথে বসে গল্প করার দৃশ্যও চোখে পড়ে। বৈচিত্র্যময় জায়গা এটি। এখন এই জায়গাটি পড়ে আছে অন্ধকার রাত্রির মতো।

সাংবাদিক সমিতির সামনের এই সুরেলা জায়গায় বাজে না কোন সুর

ক্যান্টিন: এটা হলো আড্ডা আর দুষ্টামির আতুড়ঘর। তার সাথে পুরোদমে ভুড়িভোজের গরম জায়গা। এখানের শব্দদূষণ কখনো কমে না। এখন হাজার চিৎকার করলেও এই জায়গাটিতে শব্দ দূষণ করা সম্ভব হয়না।

হিটলার চত্বর: এই হিটলার কিন্তু ঘৃণার নয় ভালোবাসার। হিটলারের দারুণ স্বাদের ঝালমুড়ি খেতে এই জায়গাটি কখনো ফাঁকা থাকে না, বেচারা হিটলরেরও দম ফেলার ফুসরত থাকেনা। জায়গাটি মূল ফটকের একেবারে সামনে হওয়ার ক্লাস করতে যাওয়ার সময় আর ক্লাস শেষ হয়ে বের এসে এক অন্যরকম সৌন্দর্য চোখে পড়তো। এখন ফাঁকা জায়গাটা দেখে হয়তো এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাদাম গাছটিও কাঁদে।

সবসময়ের ব্যস্ত হিটলার চত্বরে নেই কোন ব্যস্ততা

এছাড়া, ব্যায়ামগার, ট্রান্সপোর্ট ইয়ার, ইনডোর-আউটডের খেলার মাঠ, ছাত্র সংসদ, সাংস্কৃতিক অঙ্গন পাড়া- সব খানের প্রানের উচ্ছ্বাস এখন নিস্তব্ধ, নিরবতায়।

কিছুদিন আগেও যে ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের আড্ডা আর কোলাহলে মুখর থাকত, সে ক্যাম্পাসে শুনশান নিরবতা। নেই কোনো কোলাহল। দীর্ঘ ঈদের ছুটি আর সেমিষ্টার ছুটিতে ক্যাম্পাস কিছুদিন নিশ্চুপ থাকে কিন্তু, সেটা ক্ষনিকের। এখন একেবারেই নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

ক্যাম্পাসের চিরচেনা যেসব জায়গায় শিক্ষার্থীদের মিলত প্রাণখোলা হাসিতে, আড্ডায় মুখর সেসব জায়গা এখন শিক্ষার্থী শূন্যে নিরবতায় খাঁ খাঁ করছে। পরীক্ষার সময়ে ভালো জায়গা দখলের জন্য নিত্যদিন যে সিঁড়িতে, ক্লাস রুমে অলিম্পিক দৌঁড় প্রতিযোগিতা হতো, সেগুলো যেন নীরবে কাঁদছে, নেই কারো তাড়াহুড়ো। শুধুই নিস্তব্ধতা।

বাদাম তলার টেবিলগুলোতে নেই আড্ডাবাজদের উপস্থিতি। তারুণ্যের অনুপস্থিতিতে স্পনদনহীন হয়ে পড়ে আছে হাজারো প্রাণের কলরবে মুখরিত গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বন্ধ ক্যাম্পাস ঘুরে নিস্তব্ধতার স্বাক্ষী হয়ে ভিতরের অনুভূতি হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠে-

সবখানে বেঁচে থাকার খুদা নিয়ে
অনেকটা বিলাপ
একদম থেমে আছে।


সর্বশেষ সংবাদ