শেষ হয়ে হইল না শেষ.....

  © টিডিসি ফটো

জ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা জীবনের পাট চুকিয়ে ক্যাম্পাসের সোনালী অতীতকে বিদায় দেওয়ার পূর্বে র‌্যাগ ডের আয়োজন করা হয় ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় এবার সেটি সম্ভব হচ্ছে না। করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শেষ করা সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) এমন কিছু শিক্ষার্থীর মনের অব্যক্ত কথা তুলে ধরেছেন প্রতিনিধি তানভীর আহম্মেদ-

শিক্ষা জীবনের শেষ অধ্যায়টা আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিবাহিত করি। বলতে গেলে পরিণত বয়সের একটা বিস্তর সময় এখানে বন্ধু-বান্ধব, হৈ-হুল্লোড়, ক্লাস-পরীক্ষা, শিক্ষকের বকুনি, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রেম ভালোবাসার খুনসুটি এগুলো করতেই আমাদের সময় কেটে যায়। তাই এখানে যে ভালোবাসা, আবেগ আর অনুভূতিগুলো জমা হয়, তা হয়তো অন্য কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যায়না। কিন্তু, যখন নির্দিষ্ট একটা সময় আসে তখন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ক্যাম্পাসকে বিদায় জানাতে হয়। এই বিদায়টা কত কষ্টের সেটা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। তারপরও ক্যাম্পাসে শেষ সময়টা আনন্দ করে, সবার সাথে কাটিয়ে দিতে পারলে আলাদা একটা ভালোলাগা থাকে।

র‌্যাগ ডে'র স্মৃতি, উচ্ছ্বাস নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার মুহুর্তগুলো অসাধারণ হয়। কিন্তু, মহামারী করোনা ভাইরাস কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিল। এই সোনালী সময়গুলো জীবনে আর কোনো দিন কোথাও খুজেও পাওয়া যাবে না। ক্যাম্পাস লাইফের শেষের দিকে এসে সময়গুলো এমন হয়ে যাবে, সেটা মেনে নেয়া সত্যিই খুব কষ্টের। মুমূর্ষু রোগী যখন আইসিইউতে শুয়ে মৃত্যুর ক্ষণ গুণে, কিন্তু পাশে তার স্বজনদের কেউ থাকেনা, তখন তার পৃথিবী ছাড়তে যেমন কষ্ট হয়, ঠিক করোনায় সবাইকে পাশে না পেয়ে আমাদের ক্যাম্পাস ছেড়ে আসতে এর ব্যতিক্রম হয়নি।

মো. রোকনুজ্জামান মনি
ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল। শেষ সেমিস্টার তো আমরা পেলামই না। নানান জল্পনা কল্পনার শেষে যখন অনলাইনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার ঘোষণা এলো, সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিল। চিরচেনা ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে হেটে বেড়ানো, ফুচকা, বাদামতলা, ঝালমুড়ি, শিক্ষার্থীদের আনাগোনা, ক্লাসরুম আর প্রিয় শিক্ষকদের সাথে কথা আর তাদের সাথে দেখা হবে না ভাবতেই চোখের কোণে জল জমা হয়ে গিয়েছিল।

কখনো কখনো মনে হতো যেন স্বপ্ন দেখছি। এই যে অনলাইনে পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট এসব যেন চোখ খুললেই মিথ্যা হয়ে যাবে। আমরা আবার দৌঁড়ে বেড়াবো পুরো ক্যাম্পাস। র‍্যাগ ডে'র সাদা গেঞ্জি নিয়ে তো আমাদের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। একেক জনের একেক রংয়ের গেঞ্জি প্রিয়। সব তর্কাতর্কির শেষে বিপুল ভোটে সাদা রঙের গেঞ্জি জয়লাভ করলো। কিন্তু র‍্যাগ ডে শুধু আমাদের আলাপেই থেকে গেলো। কিছুই করা হলো না। অনেক অভিমান, বুকফাটা হাহাকার, আফসোস নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করলাম। কিন্তু অনেক স্মৃতি নিয়েই শেষ হলো আমাদের চার বছরের যাত্রা।

লাকি আক্তার
সমাজ বিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগ

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে শেষের আগ পর্যন্ত কতটা মধুর, তা বলার বাহিরে। জীবনের সেরা মুহুর্ত, স্বাদগুলো এখানেই পাওয়া যায়। কিন্তু, এই আনন্দ ঠিক ততটাই বিষাদে পরিণত হয় যখন ক্যাম্পাসকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে যায়। প্রতিটা ক্ষণ মনে হয়, কি যেন একটা নেই। কিছু একটা যেন পেছনে ফেলে চলে আসলাম। প্রতিটা জিনিসেরই শুরু এবং শেষ থাকে। সেক্ষেত্রে হাজারো কষ্ট বুকে চেপেও প্রকৃতির নিয়মটা মেনে নিতে হয়। তবুও প্রত্যেকের স্বপ্ন থাকে সুন্দর একটা শেষের। মহামারী করোনা ভাইরাস সেই সুন্দরটা আর হতে দিল না।

র‌্যাগ ডে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। শেষ সময়টা অনেক সুন্দর করে কাটাবো। সবটাই এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত। একবুক বিষাদ নিয়েই ক্যাম্পাস লাইফটা শেষ করলাম। এটা খুবই দুঃখের। ক্যাম্পাস ছেড়ে আসায় খুব মিস করব সবাইকে। মিস করব পিঠার দোকানের লম্বা সিরিয়ালে খাবার কেনা, ভালোবাসার ক্লাসরুম, ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, বাদাম তলা। নিজ ক্যাম্পাস গণ বিশ্ববিদ্যালয়কে খুব মিস করবো।

মুশফিকুর রহমান শাওন
ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ভর্তি হওয়ার পর থেকে বন্ধু-বান্ধব, হৈ-চৈ, খুনসুটি, ক্লাস-পরীক্ষা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে ফেলেছি। পরিণত বয়সের সবচেয়ে সুন্দর সময় এখানে কাটিয়েছি। সময়গুলো খুব দ্রুত চলে গেছে। এই সুন্দর সময়গুলো আমরা আর পাবোনা। এতকিছুর পরও আমাদের কিছু আক্ষেপ থেকেই গেল।

সব সময় দেখেছি বড় ভাইয়া-আপুরা র‍্যাগ ডে করেছে। যেটা এই করোনাভাইরাস এর জন্য আমরা করতে পারলাম না। প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় শিক্ষক, প্রাণের বন্ধুদের সাথে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটানো হলোনা। কিছু স্মৃতি কড়া নাড়বে সবসময় আমাদের মনে আর আক্ষেপটা যে থেকেই যাবে। আমরা এইভাবে ক্যাম্পাস থেকে চলে আসবো কখনো কেউ ভাবিনি। শেষটা আরও সুন্দর হতে পারতো।

নিশাত মীম
অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ

যেকোন জিনিসের শেষটা অনেক গুরুত্ববহ। কেননা  শুরুর দিকের সব ভুল-ত্রুটিগুলো শেষ হয় শেষের পাতায়। স্নাতক তো শেষ হলো। কিন্তু, আফসোস সেই আকাঙ্খিত শেষটা পাওয়া হলো না! নেওয়া হলো না অশ্রুসিক্ত, নির্মল, আবেগঘন মেলবন্ধনের পবিত্র ভালোবাসার স্বাদ। পাওয়া হলো না বিদায় বেলায় সব ঘনিষ্ঠ ভালোবাসাদের ভালোবাসার শেষ স্মৃতি। দেখা হলো না চোখের জলের প্রতিটি ফোটায় লুকানো চাপা ভালোবাসার আর্তনাদ। শোনা হলো না শিক্ষাগুরুদের মুখে আশীর্বাদের সেই মহাবাণী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ কয়েকটা দিন এভাবে যাবে আমরা কেউ হয়তো এমন কিছু কল্পনাতেও ভাবিনি। শুধু আমরা কেন? কোনো শিক্ষার্থীই এমন ভাববে না। র‌্যাগ ডে নিয়ে আলাদা এক ধরণের উচ্ছ্বাস সকল শিক্ষার্থীর মনেই থাকে। আমাদেরও কমতি ছিল না। কে জানতো বিশ্বব্যাপী দানা বাধা এক মহামারী সব ধূলিস্মাৎ করে দিবে। কি বলবো, এক বুক কষ্ট নিয়ে ভার্সিটি ত্যাগ করতে হলো। যা হোক, এমন একটা শেষ করার অভিঙ্গতা প্রসঙ্গে শুধু বার বার একটি কথাই মনে পড়ছে 'শেষ হয়েও হইল না শেষ'। এখন এতটুকুই আশা, সবাই যেন ভালো থাকে, সুস্থ থাকে আর ভালোবাসাটা অটুট রাখে।

হৃদয় সরকার 
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ


সর্বশেষ সংবাদ