করোনাভাইরাস

দশ দিনে দেশে আক্রান্ত হবে দেড় হাজার, নর্থ সাউথের পূর্বাভাস

  © টিডিসি ফটো

করোনা সংক্রমণের বর্তমান গতি ও ব্যাখ্যামূলক উন্নতির নির্দেশক সূচি ব্যবহার করে আগামী ১০ দিনে বাংলাদেশে কতজন ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে তা নির্ণয় করেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ দিনে দেশে সর্বনিম্ন ৭২২ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৮৫ জন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হতে পারে।

সোমবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নভেল করোনাভাইরাসের ‘কভিড-১৯ অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষক দলের সদস্যরা হলেন- অধ্যাপক আহমেদ হোসেন, প্রভাষক জুয়েল রানা, গবেষণা সহকারী শাদলী বেনজাদীদ ও অধ্যাপক গিয়াস ইউ আহসান।

গবেষণায় পূর্বাভাসটি তৈরি করতে আরিমা মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্বাভাসটি শুধু সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে প্রস্তুতির জন্য তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বই এক রকম স্থবির হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বিশ্ব কখনো পড়েনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গেল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া ভাইরাসটি সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকটতা ও বিশ্বব্যাপী দ্রুত বিস্তৃতির কারণে এক মাসের মাথাতেই ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে ‘বৈশ্বিক মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা করে। নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত (মঙ্গলবার দুপুর) ১৩ লাখ ৫৯ হাজারেরও বেশি মানুষ মহামারী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। সেদিন একসঙ্গে তিনজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। মঙ্গলবার নতুন করে ৪১ জনসহ সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৬৪ জনে। সেই সঙ্গে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছে আরো পাঁচজন। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭-তে। আক্রান্ত ও ‍মৃতের সংখ্যায় হঠাত্ এ উল্লম্ফন আতঙ্কিত করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে।

গবেষক দলের একজন সদস্য বলেন, প্রতিবেদনে এই প্রাণঘাতী মহামারী প্রতিরোধ করতে আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি সক্ষমতা, বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস বিস্তারের গতি, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, কোন বয়সী নারী ও পুরুষরা আক্রান্ত, রোগ ছড়ানোর রুটগুলো কী কী, দক্ষিণ এশিয়ায় সঙ্গে তুলনামূলক বৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ অবস্থা নিয়ে উদ্ভূত কিছু প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের ভবিষ্যত্ কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এ প্রতিবেদন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির রিয়েল টাইম তথ্যগুলোর রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে গত সোমবার।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইইডিসিআর-এর ৬ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩। ৫ এপ্রিল ১৮ জন ও ৬ তারিখেই ৩৫ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাহলে ২৭ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্তের হার ১৫৬ শতাংশ। আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হঠাত্ করেই জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে আমরা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর প্রথম ১০০ আক্রান্ত কেসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে পেয়েছি যে এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে করোনা বিস্তৃতির হার সবচেয়ে কম। যার কারণ হতে পারে খুব কমসংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা ও অপর্যাপ্ত আক্রান্তের তথ্য। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৭ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিলের মধ্য ল্যাবরেটরি ও নির্ণয় সক্ষমতা বাড়াতে ঢাকায় নয়টি ও ঢাকার বাইরে পাঁচটি করোনা নির্ণয় কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যা ২৭ মার্চে ছিল মাত্র দুটি।

৬ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ১২, অর্থাত্ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ, যা বৈশ্বিক মৃত্যুহারের (৪%) দ্বিগুণের বেশি। এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো সঠিক চিকিত্সা পদ্ধতি উদ্ভাবন হয়নি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অনুন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও চিকিত্সা সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততা সম্ভাব্য কারণ।

করোনার বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক সংক্রমণ:
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শনাক্তকৃত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩০ শতাংশ নারী। বাংলাদেশে নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেক বেশি, যা দেশে করোনা শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য নির্দেশ করে। মহামারীর প্রথম দিকে চীনের উহানেও নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যুহার অধিক ছিল। অন্যদিকে প্রবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরা প্রধান জীবিকা উপার্জক। অন্যদিকে নারীরা চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রায়ই গুরুত্ব পান না এবং রোগের লক্ষণ প্রকাশ করতে চান না। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ বলছে, ৪০-৬০ প্লাস বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। ৫০ বা এর বেশি বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর হারও অন্য বয়সীদের থেকে বেশি। তবে বেশির ভাগ মৃত ব্যক্তির কমপক্ষে অন্যান্য একটি শারীরিক জটিলতা যেমন ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ ছিল। আমাদের বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণটিও অন্যান্য গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

করোনা সংক্রমণের ভৌগোলিক বিশ্লেষণ
করোনা যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তেমনি আমাদের জ্ঞানের পরিধি আরো দ্রুত বাড়ানো প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে করোনার ভৌগোলিক বিস্তার ব্যাখ্যা জরুরি। গত ৭ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশজুড়ে ভৌগোলিক বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল হলো রাজধানী ঢাকা। যেখানে মোট ৬৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা দেশের অন্যান্য ভৌগোলিক অঞ্চলের তুলনায় সংখ্যার দিক থেকে সর্বোচ্চ। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশজুড়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এরই মধ্যে দেশের পাঁচটি বিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ (২৩ জন) ও মাদারীপুরে (১১ জন) সর্বোচ্চ পরিমাণ রোগীর সন্ধান মিলেছে। সম্ভাব্য কারণগুলো হতে পারে প্রশাসনিক ও গণপরিবহনের কেন্দ্রীয়করণ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং গার্মেন্ট শিল্প-কারখানা। গত দুই মাসে ৬০ লাখেরও অধিক প্রবাসী ঢাকা শহরকে অনুপ্রবেশের দরজা হিসেবে ব্যবহার করে দেশে প্রবেশ করেছে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। উপার্জন ও প্রশাসনিক কারণে অধিকাংশ জনগণ রাজধানীর ওপর নির্ভরশীল, যা সামাজিক স্পর্শের সম্ভাবনা ও করোনা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর আর মুসলমানরা সাধারণত মসজিদে জামাতে নামাজ পড়েন। জামাতে নামাজ পড়ার কারণে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। যাই হোক, সরকার জামাতে নামাজ পড়ার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যা দেরিতে হলেও একটি প্রশংসাযোগ্য সিদ্ধান্ত। তবে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

করোনা সংক্রমণের রুট
করোনা মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির ড্রপলেট থেকে অন্যদের সংক্রমণ করে। এছাড়া দরজার হাতল, মোবাইল ও আক্রান্ত ব্যক্তির আবাসিক এলাকায় ভাইরাসটি বিরাজ করতে পারে। সুতরাং যেকোনো ব্যক্তি এ ধরনের সংক্রমিত বস্তু স্পর্শ করার পর যদি তাদের মুখ, নাক, চোখ স্পর্শ করে, তখন তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমরা বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পরিবর্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাব্য পথগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছে গবেষক দল। করোনা সংক্রমণের রুট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বিদেশ বিশেষ করে ইউরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী প্রবাসীদের মাধ্যমে ভাইরাসটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুরুর দিকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের ১৩ জনই ইতালি থেকে দেশে ফিরেছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সৌদি আরব, বাহরাইন, জার্মানি ও কুয়েত থেকে ফিরেছিলেন ১৩ জন। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরাও এই প্রত্যাবর্তনকারীদের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায়ে হচ্ছে। তাই হয়তো আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।


সর্বশেষ সংবাদ