প্রাথমিকে পরীক্ষা থাকছে না!

পরীক্ষামুক্ত হবে প্রাথমিক শিক্ষা, এমন ধারণা থেকেই আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরীক্ষার চাপ থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে শ্রেণিকক্ষেই মূল্যায়ন করার কথা বলেন তিনি। এরপর জোরেশোরে তা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হলেও সাড়ে চার মাসের মাথায় ইউটার্ন নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরীক্ষার বদলে শ্রেণিকক্ষে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে তা ঠিক করতে না পারায় এখন ২০২১ সালে তা বাস্তবায়নের কথা ভাবা হচ্ছে। সারাদেশের বদলে আগামী বছর ১০০ স্কুলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে কারিকুলাম, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অভিভাবকদের অনীহা এবং স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন। এসব কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষামুক্ত করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক, অভিভাবকদের মতামত নেয়া হয়। সব জায়গা থেকে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এটি বাস্তবায়ন করার বিপক্ষে মত এসেছে। তারা আগামী বছর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের ১০০ স্কুলে এটি বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দেন।

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে যাচাই-বাছাই করতে এনসিটিবিসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বসেছেন। সেখানে নানা ধরনের মত এসেছে। তারা বলেছেন, ২০২১ সালে নতুন কারিকুলাম হবে। তার আগে নতুন পদ্ধতি চালু করা সম্ভব নয়। সেজন্য আগামী বছর সারাদেশের ১০০ স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন করা হবে। অভিজ্ঞতার আলোকে ২০২১ সালে সারাদেশে নতুন পদ্ধতি চালু করা হবে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আগামী বছর তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার বদলে শ্রেণিকক্ষে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে তা ঠিক করতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যে কারণে আগামী বছরও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হবে। স্বল্প সময়ের এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নন তারা। এছাড়া মন্ত্রণালয়সহ এনসিটিবির কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের কৌশল খুঁজতে গিয়ে এসব সমস্যা সামনে এসেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর আগামী বছর থেকেই শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি ধারণাপত্র তৈরি করে। গত ১৭ এপ্রিল ধারণাপত্র নিয়ে সচিব সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করেন। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিএম হাসিবুল আলমকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। কমিটিকে ১৫ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেয়া হয়; কিন্তু কমিটির প্রতিবেদন ফাইলবন্দি।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক স্তরে অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বা শিখনফলের ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যবই রচনা করা হয়েছে। একইভাবে শিক্ষক নির্দেশিকা রচনা করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এসব যোগ্যতা ও শিখনফল অনুসারে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। যেভাবে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীরা এসব যোগ্যতা ও শিখন অর্জন করছে কি না, তা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ধারাবাহিক মূল্যায়নে সেটি সম্ভব হবে। পরীক্ষার বদলে নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শোনা, বলা, পড়া ও লেখা- এ চারটি বিষয়ের ওপর মূল্যায়ন করে পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত করা হবে। এ পদ্ধতি মূল্যায়নের মাধ্যমে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা সম্ভব হবে। ফিনল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বে এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু আছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষাজীবনের শুরুতেই পরীক্ষার চাপে পিষ্ট হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সন্তানের পরীক্ষার ফল নিয়ে অভিভাবকরা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামেন। অসম প্রতিযোগিতার কারণে কোচিং বাণিজ্য মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রাথমিকের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাও ঘটছে। গড়ে উঠেছে পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে গত মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। শিশুর ওপর থেকে পরীক্ষার চাপ কমাতে ফিনল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বের আদলে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানোর নির্দেশ দেন। গত ১৩ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শিশুকে পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত চাপ না দিতে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি এটুকুই বলব, কোনোমতেই যেন কোমলমতি শিশুকে কোনো অতিরিক্ত চাপ না দেয়া হয়। তাহলেই দেখবেন তারা ভেতরে একটা আলাদা শক্তি পাবে। যায়যায়দিন


সর্বশেষ সংবাদ