১১তম গ্রেড: ইশতেহারে কী ছিল আ.লীগের প্রতিশ্রুতি?

১১তম গ্রেডে বেতন ও বৈষম্য নিরসনের দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। মূলত সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই নির্বাচনী ইশতেহারে দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দেয় আওয়ামী লীগ। বলা হয়, সব বৈষম্য নিরসন করা হবে। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো সে দাবি পূরণ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, সহকারী শিক্ষকদের ১২তম গ্রেড আর আর প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দেওয়ার প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গ্রেড পরিবর্তনের এ প্রস্তাব দিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এটি বাস্তবায়ন হলে তা মানবেন না বলে ইতোমধ্যেই হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সহকারী শিক্ষকরা।

যদিও শিক্ষকদের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবনার বিষয়টি গণমাধ্যম থেকে জানার পর তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। তবে ১১তম গ্রেডে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির কথা শোনা গেলেও প্রস্তাবনায় সেটি রাখা হয়নি। পদটি মন্ত্রণালয় এখনো সৃজন না করায় পাঠানো হয়নি বলে সূত্রটি জানিয়েছে। 

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন বৃদ্ধিসহ সরকারের নানা কল্যাণমূখী ও যুগোপযোগী উদ্যোগ সত্ত্বেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের বেতন গ্রেডসহ শিক্ষাখাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে বৈষম্য এখনও রয়ে গেছে, আগামী মেয়াদে তা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’

ইশতেহারের ৫০ নম্বর পৃষ্ঠা: টিডিসি ফটো


প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ১১তম গ্রেডসহ বৈষম্য নিরসনের দাবিতে তারা যখন আন্দোলন করছিলেন তখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এসব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারেও তাদের দাবি পূরণের বিষয়টি যোগ করা হয়। কিন্তু এখনো সে দাবি মানা হয়নি।

জানা গেছে, সর্বশেষ গত ১৩ মে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সহকারী শিক্ষক সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা বৈঠক করেন। সেখানে বেতন বৈষম্য নিরসন, শতভাগ পদোন্নতি, বিদ্যালয়ের সময়সূচি, চিত্তবিনোদন ভাতাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় দাবি মানার আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন না করার আহবান জানানো হয়। তবে এখন ১২তম গ্রেড দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসায় ফের ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা। তারা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৃথকভাবে আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করেছেন। এছাড়া দাবি মানা না হলে বৃহৎ আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ওই প্রস্তাব পাশ হলে তাদের আমাদের সঙ্গে স্পষ্ট বৈষম্য ছাড়া কিছু নয়। এটা আমরা মানব না। ২০১৫ সাল থেকে আন্দোলন শুরুর পর দাবি মানার ব্যাপারে অসংখ্যবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও ছিল।’


তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেড আমাদেরকে দিতে হবে।’ এ ব্যাপারে ঈদের পর সহকারী শিক্ষকদের সবগুলো সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে বলে জানান তিনি।

সহকারী শিক্ষক ফ্রন্টের সভাপতি ইউ এস খালেদা আক্তার বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেড দেওয়ার দাবি করছি। তারা যদি ১০ম পান তাহলে আমাদেরকে ১১তম দিতে হবে। তারা যদি নবম পান, তাহলে আমাদেরকে ১০ম দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকরা এখন কর্মকর্তার মত ভূমিকা পালন করেন। সহকারী শিক্ষকদেরকে সব কষ্ট করতে হয়, বৈষম্যের শিকারও হন তারা। এরমধ্যে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃজনসহ নানা ধরণের তালবাহান করা হচ্ছে। এটা চলবে না। আমাদেরকে প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেড দিতে হবে, এটাই শেষ কথা।’ 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের মর্যাদাপূর্ণ গ্রেড প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান ১৪তম গ্রেডের পরিবর্তে ১২তম গ্রেড এবং প্রধান শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের পরিবর্তে দশম গ্রেডে উন্নীত করতে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এ প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, শিক্ষকদের নতুন গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাবনা  অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখন উভয় মন্ত্রণালয় সভা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে শপথ নেয়ার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন জাকির হোসেন। নতুন প্রতিমন্ত্রীকে সহকারী শিক্ষকরা সংবর্ধনা দিলে সেখানে তিনি তাদেরকে প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেডে বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

এছাড়া গত ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে দিতে আদেশ প্রদান করেন। এর আগে সরকারের পরিকল্পনা ছিল প্রধান শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড ঠিক রেখে সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১২তমতে উন্নীত করা। প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেড পাওয়ায় সহকারী শিক্ষকরা ১১তম গ্রেড দেওয়ার দাবি করছেন।

শিক্ষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে এসব বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান শিক্ষকের পর একটি সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এটিরও বিরোধিতা করছেন সহকারী শিক্ষকরা। এ পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেডে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও তার পরের গ্রেডে সহকারী শিক্ষকদের রেখে দেয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে বলে তারা দাবি করছেন।

বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদ রয়েছে। প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে পাঠদানের কাজ করেন সহকারী শিক্ষকেরা। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকেরা বেতন পাচ্ছেন দশম গ্রেডে ১৬ হাজার টাকা স্কেলে। (কোর্টের রায় অনুসারে যেহেতু বকেয়াও পাবেন)। এছাড়া সহকারী শিক্ষকেরা বেতন পান ১৪তম গ্রেডে ১০ হাজার ২০০ টাকা স্কেলে।


সর্বশেষ সংবাদ