সংবেদনশীলতা নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে: চুরি যাচ্ছে শৈশব-কৈশোর

  © ফাইল ফটো

প্রায় শেষ ২০১৮। ছুঁই ছুঁই নতুন বছর ২০১৯। বছরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সবাই এখন প্রস্তুত নতুন বছরকে আলিঙ্গন করতে। আসছে বছর জানুয়ারির শুরুর দিকেই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত। সবাই দেখবে নতুন স্বপ্ন, ভাববে নতুন চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম ‘বই উৎসব’ উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ব্যস্ত নতুন শুরুর অপেক্ষায়। কিন্তু সত্যিই কী নতুন শুরু হবে? নাকি পুরনো-জীর্ণতাকে সাজানো হবে নতুন মোড়কে? শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদায়ী বছরগুলোয় শিক্ষার গুণগত মান, শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবক সম্পর্ক এবং বিদ্যায়তনগুলোর সংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। নতুন বছরে সেটিই কাটিয়ে উঠতে হবে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর আত্মবিশ্বাস ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জীবন প্রত্যাশার ভারে জর্জরিত। সব সময় ভালো ফল করার দৌঁড়ে ছুটছেন। যে শিশুরা এই দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়ছে, তাদের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সন্তানকে প্রতি মুহূর্তে হতাশায় ডুবতে দেখে অনেক অভিভাবক তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছেন না। তারাও ছুটছেন এবং সন্তানদের হতাশা তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।

রাজধানী ঢাকার এক অভিভাবক অভিযোগের সুরে বলছিলেন, ‘মনে পড়ে না, শেষ কবে আমার সন্তানদের সম্পর্কে স্কুল থেকে ইতিবাচক কথা শুনেছি। প্রতিটি প্যারেন্টস মিটিংয়ের আগের রাত যেন আমার কাছে পরীক্ষার আগের রাত। নির্ধারিত দিনে দুরুদুরু বক্ষে হাজির হই স্কুলে। শুনি ওদের নামে একগাদা নতুন অভিযোগের ফিরিস্তি। ওদের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চোখে গুণাবলি, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর জন্যই ওরা অভিযুক্ত। শিশুরা যেন দম দেওয়া কলের পুতুল কিংবা রোবট। স্কুলের প্রত্যাশা- শিশুরা হবে সব ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে, ওদের সব আচার-আচরণ হবে পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত। শহরের তথাকথিত ভালো স্কুলগুলোতে খারাপ ছাত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরীর বলেন, ‘আমার প্রায়ই মনে হয়, আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে সম্পর্ক ছিল, সেই স্বর্ণযুগটা পার হয়ে গেছে! তখন শিক্ষা কোনো পণ্য হয়ে ওঠেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না। কোচিংয়ের জটিলতা ছিল না। যেটা ছিল, সেটা নিজেদের শিখন-শিক্ষণ সম্পর্ক। শাসন করেছেন শিক্ষকেরা, কিন্তু অপমান করেননি।’

তিনি আরো বলেন, এখন আমরা তার উল্টো দৃশ্য দেখতে পাই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে না তাদের কোনো শিক্ষক তাদের আদর্শ (রোল মডেল) হতে পারবেন! বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অবনতির দিককেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। শিক্ষকেরা অবশ্যই শাসন করবেন, তবে সেটা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। অল্প বয়সে শিক্ষার্থী ভুল পথে যেতেই পারে। এ জন্য তাকে বারবার বোঝাতে হবে, এটা তোমার জন্য ঠিক পথ নয়। সঠিক পথে এসো। তাকে কখনোই এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়, যাতে সে অপমানিত বোধ করে, সংবেদনশীল মনে ক্ষত তৈরি হয়। এটা শিক্ষকদের প্রতি আবেদন। তাঁরা শ্রেণিকক্ষের চালিকা শক্তি, আগামীর নেতৃত্ব গড়ার কারিগর।

সম্প্রতি প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট–২০১৭-এ স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নৈতিকতার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে করে না। আরও মজার তথ্যটি হলো- প্রায় অর্ধেক শিক্ষক নিজেরাও নিজেদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেন না। ফলে শহরের স্কুলগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য আর আনন্দদায়ক শিক্ষালয় থাকছে না; হয়ে উঠছে মানসিক চাপ ও পীড়নের ক্ষেত্র। এসব স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত- শিক্ষকদের গুণগত মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

সরকারি এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী-শিক্ষক তার শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে চেনে না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি অনেক ক্ষেত্রেই হালকা হয়ে গেছে। ৭০-৮০-র দশকে দেখেছি, আমাদের স্কুলের সব শিক্ষক স্কুলের প্রায় সব ছাত্রকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, ছাত্রদের পারিবারিক খোঁজ-খবর রাখতেন। সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য এই সম্পর্কটা অত্যন্ত জরুরি। শহরের নামিদামি স্কুলগুলোতেও এই দিকটা নিয়ে কোনো আগ্রহ সচরাচর দেখা যায় না। যেটা একজন শিক্ষাথীর সুষ্ঠু প্রতিভা বিকাশের অন্তরায়।

শিক্ষকদের পাশাপাশি ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদেরও শিক্ষার্থীদের অভাব-অভিযোগগুলো সমাধানে সক্রিয় হতে হবে। কমিটির সদস্যদের অসেচতন অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। ওই কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা, আর্থিক, প্রশাসনিক কার্যক্রম, লেখাপড়ার মান, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের দায়িত্বটা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থেকে যায়। একজন শিক্ষার্থী কী ধরনের পারফরমেন্স করছে, কীভাবে তার লেখাপড়ার মান আরও বৃদ্ধি করা যায়; অভিভাবককে তা অবহিত করার দায়িত্ব ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিতে হবে।

এমনকি বর্তমানে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, একসময় গুরু কিংবা শিক্ষকের মুখনিঃসৃত বাক্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করত শিষ্য বা শিক্ষার্থীরা। দু’পক্ষের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এ সম্পর্কের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ভালোবাসা ও আন্তরিকতার পরিবর্তে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কে জায়গা নিচ্ছে বৈরিতা। বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের অবনতিকে উচ্চশিক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে এই বিপরীতমুখী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সে ধারণাই বহন করে। অথচ বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকের হামলার শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে। এটি খুবই দুঃখজনক ও হতাশাজনক।

তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। অথচ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে। এর কারণ হলো, এখনকার শিক্ষকরা আগের মতো শিক্ষাদানকে ব্রত হিসেবে নিতে পারছেন না। অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা শিক্ষার্থীদের মনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গাটা তৈরি করতে পারছেন না। আর সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা না থাকার কারণে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসংবেদনশীলতা ভুলে যেতে চাই গত। বেরিয়ে আসতে চাই গত থেকে। একটা নতুন শুরু চাই। সেই শুরুটা হবে ১ জানুয়ারি, ২০১৯ দিয়ে।


সর্বশেষ সংবাদ