তিনি সরকারি কর্মকর্তা, তিনি যুবলীগের সহসভাপতি

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বদলি হওয়া খাদ্য পরিদর্শক খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগে একাধিক বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ঘুষ নেয়ার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে। ৫ বছর আগে কিশোরগঞ্জের ভৈরব খাদ্য গুদামে চাকরিজীবন শুরুর পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। এরই মাঝে সরকারি চাকরির পাশাপাশি তিনি হয়ে যান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি।

জানা যায়, দুই জন রাইস মিল মালিকের কাছ থেকে ৪৭ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর প্রায় এক বছর আগে তদন্ত কমিটি করা হয়। ওই তদন্ত রিপোর্টে ঘুষ নেয়ার প্রমাণও মেলে।

এছাড়া ৪ মাস আগে তার বিরুদ্ধে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও অদৃশ্য কারণে সেটির কাজ আজও শেষ হয়নি। দলীয় পদে থেকে সরকারি চাকরি করা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে খাদ্য পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের নেতৃত্বে যখন যুবলীগের কমিটি হয় তখন তিনিই আমাকে ওই পদে বসান। আর এতে যদি সরকারি চাকরি চলে যায়, যাবে। আর সরকারি চাকরি কারার ইচ্ছাও নেই। আর কিছু দিনের মধ্যেই তো যুবলীগের নতুন কমিটি হচ্ছে।

সরকারি চাকরি করে রাজনৈতিক দল করা যায় কি না এ নিয়ে কথা হয় কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা ফারজানার সঙ্গে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯ এর ২৫ ধারা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। প্রমাণ সাপেক্ষে অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া বিধান রয়েছে।

অথচ যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় পদধারী এই নেতার সঙ্গে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাটের সঙ্গে তার একাধিক ছবি তার ফেসবুক ওয়ালেই রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, ভৈরবে চাকরি করার সময় তিনি সপ্তাহে একদিন অফিসে সময় দিলেও বাকি সময় তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকতেন। কয়েক মাস আগে তাকে একবার বদলি করা হলেও প্রভাব খাটিয়ে তিনি তা ঠেকিয়ে দেন। তবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর তাকে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল খাদ্য গুদামে বদলি করা হয়।

ভৈরবের এক রাইস মিল মালিক জানান, সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ করতে গেলেই টনপ্রতি ২-৩ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হতো তাকে। না দিলে চাল খারাপসহ নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেয়া হতো।

তার রাজনৈতিক পরিচয়ের দাপটে তার বিরুদ্ধে কিছুই করার ছিল না। ভৈরবে চাকরি করলেও তিনি পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন। সপ্তাহের একদিন নিজেই ড্রাইভ করে দামি ভাইভেট কারে করে ভৈরব যেতেন এবং একসঙ্গে পুরো সপ্তাহের সই করতেন। সপ্তাহের বাকি দিন ঢাকায় বসেই অফিস পরিচালনা করতে বলেন সেখানকার কর্মচারীরা জানিয়েছেন।

তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে ভৈরবের বিভিন্ন রাইস মিলারের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের বিনিময়ে মোটা অংকের ঘুষ নেয়া। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে দুজন রাইস মিল মালিক ৪৭ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগে দুদক চেয়ারম্যান ও খাদ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন। এর মধ্যে ভৈরব অটো রাইস মিল মালিক ও চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ করেন।

একই বছর ৬ নভেম্বর তামজিদ অটোরাইস মিল মালিক তারিক আহমেদ টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে ২২ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার অভিযোগ করেন খাদ্যমন্ত্রীর কাছে। পরে ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির রিপোর্টে অভিযোগের সত্যতা মেলায় তার বিরুদ্ধে খাদ্য অধিদফতরে বিভাগীয় মামলা হয়।

মামলাটি এখন ধীরগতিতে চলছে। পরে খাদ্য অধিদফতর গত ১৬ জুন ময়মনসিংহের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

তার পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী হলেও ঢাকায় তার নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে বলে জানা গেছে। ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করে খোরশেদ আলম বলেন, রাইস মিল মালিকদের সুবিধা দেয়নি বলেই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক, অসত্য অভিযোগ করেছে। অডিও রেকর্ডে ঘুষ দাবির প্রমাণ থাকার কথা বলা হলে তিনি বলেন, ওই কণ্ঠস্বর আমার নয়, নকল।

ভৈরবে নিয়মিত অফিস না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অভিযোগটি অসত্য। হাজিরা খাতায়ই তার প্রমাণ রয়েছে। খোরশেদ আলমের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী এবং সম্রাটের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ায় হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যও ছিল বেশি। সম্রাট গ্রেফতার হওয়ার পর তার সাফাই গেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কথা হয় ময়মনসিংহের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি। ঘটনার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তার বিরুদ্ধে ঘুষসহ অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। শিগগির তদন্ত কাজ শেষ করে খাদ্য অধিদফতরে রিপোর্ট দেয়া হবে। জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে তদন্তের বিলম্ব নিয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক নাজমুন্নাহার খানম বলেন, নানা কারণে দেরি হয়ে গেছে। আশা করছি দ্রুত রিপোর্ট পাওয়া যাবে।

কিশোরগঞ্জের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তানভির হোসেন বলেছেন, ভৈরবে কর্মরত অবস্থায় খোরশেদ আলমের অনিয়মে শেষ ছিল না। মাসে বড়জোর ৪-৫ দিন অফিস করতেন। দুজন রাইস মিল মালিক সরাসরি ঘুষের অভিযোগ দিয়েছে এবং ঘুষ দাবির অডিও রেকর্ডও আছে একজন মিল মালিকের কাছে । এখন বিভাগীয় মামলায় যা হওয়ার তাই হবে।

বিষয়টি মহাপরিচালক দেখছেন। রাজনৈতিক সংগঠনের বড় একটি পদে থেকে খোরশেদ আলম কী করে সরকারি চাকরি করে যাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি যে দল করেন তা আমাদের জানা নেই। কেউ অভিযোগও করেননি।


সর্বশেষ সংবাদ