দুই বছরে কোটিপতি কৃষক লীগ নেতা রিপন

এস এম রিপন
এস এম রিপন   © সংগৃহীত

তিন বছর আগেও উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের খালপারের ফুটপাতে নিজ হাতে চা বানিয়ে বিক্রি করতেন এস এম রিপন। সে সময় মাঝেমধ্যে দোকান বন্ধ করে স্থানীয় বিএনপি নেতা মোস্তফা কামাল হৃদয়ের সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ে যেতেন। বর্তমানে তিনি তুরাগ থানা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতির ক্ষমতা অতি দ্রুত তাঁকে বিত্তশালী করে তোলে। তুরাগ থানার চণ্ডলভোগ এলাকায় সম্প্রতি তিনি নির্মাণ করেছেন দুটি আলিশান বাড়ি। একটি পাঁচতলা, অন্যটি চারতলা। ঘুরে বেড়ান প্রিমিও গাড়িতে করে। রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় তুরাগের মাদক বেচাকেনার নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন ও ফুটপাতের চাঁদাবাজি রাতারাতি তাঁকে ধনাঢ্য করে তোলে। এসবই করেন তিনি রাজনীতির পদ-পদবি ব্যবহার করে। ২০১৬ সালে উত্তরার এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার সহায়তায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লেখান রিপন।

এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক কাজে যুক্ত ব্যক্তি কৃষক লীগের পদ-পদবি ব্যবহার করে মাত্র তিন বছরে কিভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন, বিষয়টি সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করে দেখব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঘোষণা, হাইব্রিডদের দলের কোনো পদে রাখা যাবে না। কৃষক লীগ দ্রুতই নেত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন করবে।’

নব্য কৃষক লীগ নেতা রিপনের দাপটে মুখ খোলার সাহস পায় না তুরাগ থানার চণ্ডলভোগ এলাকার সাধারণ মানুষ। স্থানীয় প্রভাবশালী আরেক নব্য আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন রিপন। রাজনৈতিক পদ-পদবি ব্যবহার করে তুরাগ এলাকায় ইয়াবা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করলেও রিপন থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তুরাগ এলাকার এক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজনীতি এদের কাছে আলাদিনের চেরাগের মতো। চাঁদাবাজি, মাদক নিয়ন্ত্রণ করে এরা রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে। নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী রাখায় এদের বিরুদ্ধে কথা বলে এলাকায় থাকা অসম্ভব।’

তুরাগ থানা এলাকায় অনুসন্ধান করে জানা যায়, তুরাগ থানার ১৬টি স্পটে বিক্রি হয় ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্য। ওই ১৬টি মাদক স্পটের মধ্যে ছয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন কৃষক লীগ নেতা এস এম রিপন। স্পটগুলো হচ্ছে ট্যাকপাড়া এলাকা, ১২ নম্বর সেক্টর ও ১৯ নম্বর সেক্টরের সংযোগস্থল। এই দুই স্পটে রিপনের হয়ে ইয়াবা বিক্রি করে ইকবাল নামের এক যুবক। ফুলবাড়িয়া আজাদ স্কুলের বিপরীতের বস্তি, এ বস্তিতে মাদক বিক্রি করে সীমা নামের এক নারী। ওই বস্তিতে মাদক বিক্রির আরেকটি স্পট রয়েছে, যেখানে মাদক বিক্রি করে কবির ও রিপন নামে দুই যুবক। ফুলবাড়িয়া নতুন রাস্তা স্পটে কৃষক লীগ নেতা রিপনের হয়ে মাদক বিক্রি করে মুরগি লিটন। উত্তরা উইমেন কলেজের পাশের স্পটে মাদক বিক্রি করে ইউসুফ নামের এক যুবক।

এই খুচরা মাদক বিক্রেতারা জানায়, মাদক বিক্রির লাভের বড় একটি অংশ দিতে হয় রিপনকে। ফলে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার লোকেরা তাদের আর বিরক্ত করে না। নির্বিঘ্নে তারা মাদক কারবার করতে পারছে। ইয়াবা ক্রেতা সেজে ওই সব স্পটে গিয়ে আলাপ শেষে গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় দিলে তারা বলে, ‘পত্রিকায় আমাদের বক্তব্য প্রকাশ পেলে খুন হয়ে যাব। দয়া করে আমাদের বক্তব্য প্রকাশ করবেন না।’

তুরাগ থানার চণ্ডলভোগ এলাকায় কথা হয় একাধিক এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারা জানায়, তিন বছর আগেও কৃষক লীগ নেতা রিপনের পরিবার বসবাস করত টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির দেয়ালঘেরা বাড়িতে। কৃষক লীগ নেতা হওয়ার পর রিপনের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। এখন চণ্ডলভোগ এলাকায় তুরাগ মৌজায় রিপনের রয়েছে পাঁচতলা ও চারতলা দুটি বাড়ি।

দিয়াবাড়ী এলাকা থেকে উত্তরার হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত ৪৭০টি লেগুনা চলাচল করে। প্রতিটি লেগুনা থেকে দিনপ্রতি চাঁদা আদায় করা হয় ১৮০ টাকা করে। একাধিক লেগুনাচালক জানায়, কৃষক লীগ নেতা রিপন ওই চাঁদা আদায় করেন। এ খাত থেকে তাঁর দিনে আয় ৮৫ হাজার টাকা। ওই টাকার ভাগ স্থানীয় আরো কয়েকজন নেতাকে দিতে হয়।

উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের খালপার থেকে নয়ানগর পর্যন্ত চলাচল করে ১২০টি ইজি বাইক। এসব ইজি বাইক থেকে চাঁদা আদায় করেন উত্তরার ক্ষমতাসীন দলের আরেক নেতা বিল্লাল হোসেন। তাঁর পক্ষে রফিক নামের একজন চাঁদা সংগ্রহের কাজ করেন। রফিক বলেন, ইজি বাইক থেকে আদায় করা চাঁদার টাকা থেকে প্রতি মাসে রিপনকে দিতে হয় সাত হাজার টাকা।

উত্তরার ১২ নম্বর খালপার এলাকার ফুটপাতে চা, সবজি, কাপড় ইত্যাদির ১৭৫টি দোকান বসানো হয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয় ৫০০ টাকা হারে। এই হিসাবে দিনে ওই ফুটপাত থেকে আদায় করা হয় ৮৭ হাজার টাকা। স্থানীয় নেতা, পুলিশসহ বিভিন্ন স্তরে ভাগ-বাটোয়ারার পর দিনে রিপনের আয় থাকে ৪০ হাজার টাকা।

চণ্ডলভোগ এলাকার ৩০ হাজার বাসিন্দা জিম্মি ময়লা পরিষ্কার ও ডিশ ব্যবসা সিন্ডিকেটের হাতে। ওই সিন্ডিকেটের প্রধান কৃষক লীগ নেতা রিপন। কোনো পরিবারের লোক নিজেরা যদি বাড়ির ময়লা-আবর্জনা ভাগাড়ে রেখে আসে, তার পরও তাদের ময়লা বাবদ পরিশোধ করতে হয় ৫০ টাকা। রিপন এ কাজে কয়েকজন যুবককে নিয়োগ দিয়েছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা নিয়ে আসে। পরিবারপ্রতি ৫০ টাকা করে আদায় করলে প্রতি মাসে আয় হয় ১৫ লাখ টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, চণ্ডলভোগ এলাকায় প্রায় ২০ হাজার বাড়িতে ডিশের লাইন রয়েছে। প্রতিটি পরিবার থেকে ডিশের লাইন বাবদ আদায় করা হয় ২০০ টাকা করে। এই হিসাবে এ বাবদ আদায় করা হয় ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ডিশের লাইন সংযোগ দেওয়ার সময় নেওয়া হয় এক হাজার টাকা করে। ওই টাকা অফেরতযোগ্য। প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ থেকে এক হাজার পরিবার চাকরির বদলিজনিত কারণে বাসা ছেড়ে দেয়। ওই সব বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এলে তাদের কাছ থেকে নতুন করে সংযোগ বাবদ এক হাজার টাকা করে আদায় করা হয়।

হঠাৎ বিত্তবান কৃষক লীগ নেতা এস এম রিপন বলেন, ‘আমি ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থকড়ি আয় করেছি। এ ছাড়া চণ্ডলভোগ এলাকায় আমার পারিবারিক জমিজমা আছে।’ ফুটপাত, পরিবহন থেকে চাঁদাবাজির বিষয় অস্বীকার করে রিপন বলেন, ‘যারা চাঁদাবাজি করে তাদের ধরিয়ে দিন।’ সিন্ডিকেট করে ময়লা বাণিজ্যের কথাও অস্বীকার করেন রিপন। তবে তিনি বলেন, ‘আমরা ১২ জন মিলে এলাকার ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করি। আমি কখনো মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত নই। এগুলো অপপ্রচার। আর আমি নব্য আওয়ামী লীগার নই। অনেক আগে থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’


সর্বশেষ সংবাদ