দেবদাস থেকে জীবন্ত শহীদ যিনি

করোনা সংকটের মধ্যে নীরবে চলে গেলন ‘জীবন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী’ নামে খ্যাত ড. মজিবর রহমান দেবদাস। তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যা, তাণ্ডবলীলা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখে নিজের নাম পরিত্যাগ করে নতুন নাম ‘দেবদাস’ ধারণ করেন।

১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি জয়পুরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন ড. মজিবুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে পড়াশোনা শেষ করে তিনি বগুড়া ও কুমিল্লার দুটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে মেলবোর্নে যান উচ্চতর শিক্ষার জন্য। ফিরে এসে তিনি যোগ দেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে সেখান থেকে চলে আসেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু পাকিস্তানীদের পাশবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর আর ফেরা হয়নি অধ্যাপনায়।

সোমবার সকালে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে জয়পুরহাটের নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। দুপুরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পুলিশের একটি দল তার মরদেহে রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করে। পরে তাকে জয়পুরহাট জেলার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পুলিশের একটি দল তার মরদেহে রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করে

 

মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যা, তাণ্ডবলীলা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দেখে নীরব থাকতে পারেননি অধ্যাপক মজিবর রহমান। এতে অতিষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি। তাই ১৯৭১ সালের ১০ মে মজিবর রহমান তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা নষ্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্মিদের ক্যাম্পে পরিণত করবার জন্য একটি ইংরেজিতে প্রতিবাদ লিপি দেন। মুসলমান হয়ে আর এক মুসলমানের উপর পাকবাহিনীর নির্মমতা দেখে নিজের নাম পরিত্যাগ করে নতুন নাম ‘দেবদাস’ ধারণ করেন। প্রতিবাদ লিপিতে পূর্বের নাম উল্লেখসহ পরিবর্তিত নাম ‘দেবদাস’ উল্লেখ করেছিলেন।

আর দেবদাসের চিঠি পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সামরিক দপ্তরে। ১৯৭১ সালের ১২ মে এ প্রতিবাদী অধ্যাপককে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রায় চারমাস ধরে তার ওপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনে অধ্যাপক রহমান যখন বদ্ধ উন্মাদপ্রায় তখন ৫ সেপ্টেম্বর ’৭১ তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় নাটোর ক্যাম্প থেকে।

দেবদাস স্বাক্ষরে প্রতিবাদ লিপিটি

এছাড়া লোকমুখে আরেকটি কথা প্রচলন রয়েছে- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের নিপীড়নের মুখে যখন বাংলাদেশের অনেক হিন্দু যখন জীবন বাঁচাতে হিন্দু নাম বাদ দিচ্ছিল, তখন নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘দেবদাস’ রাখেন মজিবর রহমান।

এদিকে স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে অবস্থানের সুযোগ ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে সিন্ডিকেট সভায় এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতীয় অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ সালাহউদ্দিন আহমেদের (তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন) একান্ত চেষ্টায় শহীদদের পরিবারকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা অধ্যাপক মজিবুর রহমান দেবদাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে এ মর্মে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে থেকেই তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘জীবন্ত শহীদ’ বলে।

পাকিস্তানীদের পাশবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। বেঁচে থাকলেও তিনি ছিলেন অনেকটা স্মৃতি বিভ্রম, যেন জীবন্ত শহীদ অর্থাৎ জীবিত থেকেও মৃত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অকৃতদার এই বুদ্ধিজীবী এভাবেই বেঁচে ছিলেন।

এছাড়া তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য তাকে পাবনা হেমায়েতপুর মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে। তিনি কোনো পাগল নন এ কথা বলে হেমায়েতপুরে চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। হেমায়েতপুর থেকে এসে তিনি চলে যান একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ তার খোঁজখবর জানতেন না। দৈনিক আজকের কাগজের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রতিনিধি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান তার খোঁজ পেয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন, যা ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরে আসে।

অবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ত্যাগ ও অবদানের জন্য তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করে ১৯৯৮ সালের ১২ আগস্ট। আর স্বাধীনতা লাভের ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর হাতে উঠে সম্মাননা পদক।