নিভে গেল ঢাকার শেষ আর্মেনিয়ান প্রদীপটিও

অনেকটা নীরবেই প্রস্থান ঘটলো পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের অবশিষ্ট মানুষটির। বাকীরা আগেই চলে গেছেন। কেউ কবরে, বেশির ভাগই বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। স্বজন-পরিজনহীন অবস্থায় মাইকেল জোসেফ মার্টিন বাংলাদেশের মাটি কামড়ে পড়েছিলেন অনেকটা আবেগে। হয়তো চেয়েছিলেন জীবনের বাকিটা সময় এখানেই কাটাতে। কিন্তু না, স্রষ্টার অমোঘ নিয়তি।

৩০ বছরের বেশি সময় ধরে পুরান ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চকে আগলে রাখা সেই মার্টিন মৃত্যুবরণ করেছেন। মার্টিনের স্ত্রীর মৃত্যুর পর ২০১৪ সাল থেকে কানাডার অন্টারিওতে মেয়েদের সঙ্গে বসবাস করে আসছিলেন। গত ১০ এপ্রিল সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

১৯৩০ সালের ৬ জুন বার্মার রেঙ্গুনে জন্ম নেওয়া মার্টিন পরিবারের সঙ্গে ৪০ এর দশকে ঢাকায় আসেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন গির্জা আর্মেনিয়ান চার্চ অব হলি রেজারেকশনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন মার্টিন।

বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য বিস্তার ধর্মপ্রচার আর উপনিবেশ স্থাপনের দৌড়ে অষ্টাদশ শতকের দিকে ঢাকায় এসে বসতি গড়েছিল আর্মেনীয়রা। ঢাকার আরমানিটোলার নামও সেখান থেকেই এসেছে। ১৭৮১ সালে আরমানিটোলা ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মাঝামাঝি এলাকায় গ্রিক অর্থডক্স মতের অনুসারী এই গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নিকোলাস পোগজসহ চারজন বিত্তবান আর্মেনীয়র পৃষ্ঠপোষকতায়। আরমানিটোলার ওই গির্জা যেখানে তৈরি হয়েছিল সেখানে আগে ছিল আর্মেনীয়দের কবরস্থান। গির্জার প্রাঙ্গণে এখনও ৩২৫টি কবর রয়েছে। আর্মেনীয় স্থাপত্য রীতিতে গড়া এই গির্জা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও পরে আবার মেরামত করা হয়।

গির্জা প্রাঙ্গণের এক দিকে লাল ইটের অতি পুরনো এক বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন গির্জা পালক মার্টিন। তার দয়িত্ব ছিল গির্জার শত বছরের পুরনো জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ রেজিস্ট্রারগুলো সংরক্ষণ করা, কবরস্থানের যত্ন নেওয়া এবং বাংলায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রাখা।

২০০৩ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইকেল জোসেফ মার্টিন বলেছিলেন, এই গির্জা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হোক তা তিনি চান না। তিনি বলেছিলেন, আমিই হয়ত বাংলাদেশে বসবাসকারী শেষ আর্মেনীয়। কিন্তু আমার পর অন্য কেউ যেন আর্মেনিয়া থেকে এসে এই দায়িত্ব নেয়, সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব। তা না হলে শত বছরের এই ঐতিহ্য রাতারাতি ধুলায় মিশে যাবে।

স্ত্রী ভেরোনিকা মার্টিন ২০০৫ সালে মারা গেলে বৃদ্ধ মার্টিন একা হয়ে যান। ততদিনে তাদের তিন মেয়ে কানাডায় থিতু হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তখন আরমানিটোলার একমাত্র আর্মেনীয়। কিন্তু গির্জার মায়া ছাড়তে পারছিলেন না মার্টিন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ব্যবসার সূত্রে ঢাকায় আসেন আরেক আর্মেনীয় আর্মেন আর্সলানিয়ান।

মেয়ের কাছে জানতে পারেন পুরান ঢাকায় একটি আর্মেনীয় চার্চ থাকার কথা। সেখানে গিয়ে দেখা পান ওয়ার্ডেন মার্টিনের। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সখ্য। পরে একবার স্ট্রোক করার পর ঢাকায় একা থাকা মার্টিনের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে তিনি গির্জা পালকের দায়িত্ব আর্মেন আর্সলানিয়ানের হাতে দিয়ে কানাডায় সন্তানদের কাছে চলে যান।


সর্বশেষ সংবাদ