ছাত্রীদের অভিনয়ে অনুমতি ছিল না, অভিভাবকদের চিঠি দিয়ে আনা হয়

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান  © টিডিসি ফটো

ড. শেখ আবদুস সালামের সম্পাদনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা-সহায়ক কর্মকান্ড: সেকাল একাল নামক গ্রন্থে (ফ্রেব্রুয়ারি ২০১৮) প্রকাশিত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের লেখা-

আমি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত হই। আমাদের সময়ে, প্রকৃতপক্ষে, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই আবাসিক হলগুলো ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জীবনের মূল কেন্দ্র। এটি ধারণা করা হয়েছিল যে, আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধিত হবে। সেই জন্য যারা আবাসিক তো বটেই, যারা অনাবাসিক তাদের জন্য হলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আবশ্যক ছিল এবং হলের সাংস্কৃতিক কাজকর্মে তাদের অংশগ্রহণ ছিল প্রত্যাশিত।

আমি বলেছি যে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাথে আমি যুক্ত ছিলাম, অনাবাসিক ছাত্ররূপে। তখন আমাদের সব হলেই ছাত্রদের সাহিত্যসংকলন বা বার্ষিকী প্রকাশিত হতাে। বার্ষিক নাটক হতে, সাহিত্য-প্রতিযোগিতা হতো এবং বার্ষিক ক্রীড়া-উৎসব হতো। নাটক ও অভিনয় হতে। আমরা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বার্ষিকীর দায়িত্ব কিছুটা নিয়েছিলাম। নানা কারণেই আমাদের বছরে বার্ষিকী বের করতে দেরি হচ্ছিল বলে আমাদের পরবর্তী বছরের সঙ্গে মিলে আমরা যুগ্মসংখ্যা বের করি। এ বার্ষিকীর সম্পাদক ছিলেন আজহারুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন আল আজাদ। যুগ্মসম্পাদক ছিলাম আমরা চারজন : অর্থনীতির মুজাফফর আহমেদ, ইংরেজির সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অর্থনীতির কবির উদ্দীন আহমদ এবং বাংলার আমি। মূলত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মুজাফফর আহমদ এবং আমি মিলে এই দুই-বছরের বার্ষিকী যুক্ত সংখ্যা বের করি। আমাদের অনুরােধে জয়নুল আবেদীন এর প্রচ্ছদ এঁকে দেন। সেটি তার সেই বিখ্যাত গরুর গাড়ি ঠেলার ছবি। তখন ছাত্র ছাত্রীরা ঠাট্টা করে যে হল, কাদায় আটকে গিয়েছিল, যুগ-সম্পাদকরা সেটা ঠেলা দিয়ে বার করছে।

আমরা ঠিক করলাম যে, আমাদের বার্ষিকীতে আমরা একটু সাহিত্য সংকলনের মর্যাদা দেব। সেই জন্যে আমরা ঘােষণা করে দিলাম যে, আমরা কোন ছবি ছাপব না। কাজেই ইউনিয়নের ছবি, অ্যাথলেটিক ক্লাবের ছবি প্রভোস্টের ছবি— যেগুলো সাধারণত ছাপানো হয়, তার কোনটাই আমরা নিই নি। আমরা কিছু বিভাগীয় রচনা নেই, চলচ্চিত্র, বেতার নাটক—এইসব নিয়ে এবং কিছু-কিছু লেখা নিজেরা তৈরি করে ছদ্মনাম দিয়ে ছেপে দেই।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য চর্চা খুব উল্লেখযোগ্য মানের ছিল। আমাদের লেখকদের মধ্যে ছিলেন (ছাত্র হিসেবে) শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, তারপর জহির রায়হান বোধ হয় ছিল; এটা তো ছিল না ডাকসু ম্যাগাজিনে ছিল, এখন ঠিক নিশ্চিত নই। শফিক রেহমান, সাংবাদিক, উনি ছিলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ তো ছিলেনই, এরকম অনেকেই ছিলেন। মাহফুজ আনামের বড় ভাই মাহবুব আনাম, উনি ছিলেন। বেশ কিছু ভাল লেখা আমরা পেয়েছিলাম। শিক্ষকদের মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেনের একটা পুরোনো লেখা পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের লেখা পেয়েছিলাম। আমারও একটা বড় প্রবন্ধ তাতে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই প্রবন্ধের কথা বলি একটু। ওই প্রবন্ধ পড়ে আমার বিভাগের যিনি প্রধান মুহম্মদ আবদুল হাই, তিনি বললেন যে, তোমার তাহে গবেষণামূলক লেখার দিকে ঝোঁক আছে মনে হয়। তুমি এমএ পাস করে গবেষণা করো। তখন গবেষণা কি এসব আমার মাথায় ছিল না। আমি হাঁ-হাঁ করে গেলাম, এ পর্যন্তই। কিন্তু পরে সত্যিই তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। কাজেই হল ম্যাগাজিনে আমার লেখাটা পড়ে আমার গবেষণায় আগ্রহের বিষয় তিনিই সূচনা করে দিয়েছিলেন।

তারপর আমাদের সময় নাটক যে হতাে, সেইটার একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। তার আগে পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের ভূমিকা গ্রহণ করতেন। আমরাই প্রথম প্রভােস্টকে গিয়ে বললাম যে, স্যার আমাদের নাটকে মেয়েদের চরিত্রে মেয়েরা অভিনয় করবে। তখন মেয়েদের কোনো আলাদা হল ছিল না, কাজেই মেয়েরা ছেলেদের যে হলগুলাে তাতে সংযুক্ত হয়ে ছড়িয়ে থাকতাে। আমাদের হলে মেয়ে বেশ কিছু ছিল, অনাবাসিক। কেউ কেউ উইমেন্স হল বলে ছোট্ট একটা হোস্টেলে বাস করত। প্রভোস্ট বললেন যে, আমি অনুমতি দিতে পারি যদি তোমরা তাদের অভিভাবকের কাছ থেকে লিখিত চিঠি আনতে পারে যে, তাদের এই মেয়ের অভিনয়ে কোনো আপত্তি নেই। তো সেই রকম হলাে, আমরা দু-তিনজন অভিভাবকের চিঠি আনলাম এবং মেয়েরা অভিনয় করল। এটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নতুন সূচনা।

তারপর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যে বিতর্ক হতাে, তার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে, ছাত্র-শিক্ষক নন এমন অনেকে অংশ নিতেন। এর মধ্যে সচিবালয় থেকে আসতেন সচিবরা কেউ-কেউ, হাইকোর্ট থেকে বেশ নাম করা আইনজীবীরা, তারপরে অন্য কলেজের ছাত্র বা শিক্ষক–এর অংশ নিতেন। সেদিক থেকে আমাদের এই বিতর্কগুলোর মান খুব উঁচু দরের ছিল। তারপর ছিল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, সেখানে গান আবৃত্তি—এইগুলাতে ভরে থাকতো; বেশ ভাল হতে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতাে, সেটা উল্লেখযোগ্য ছিল; যার যার হলের মাঠে খেলা হতে। আমরা কখনো কখনো-বা খেলা দেখতে যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে খেলার মাঠ। সেটায় খেলাধুলা হতো। আমি যেটা বলতে চাই যে, তখন সব দিক থেকে এই পাঠ্যাতিরিক্ত অনুশীলন এটা খুব ভালোভাবে হতে। হলের নিজস্ব টেনিস লন ছিল, ব্যাডমিন্টন কোর্ট ছিল, ফুটবল মাঠ ছিল। এখানে যারা খেলাধুলা করেন তারা অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে পরে খেলেছেন।

তাে এইটুকুই আমি বলতে চাই। তখন আমাদের তিনটা হল কার্যকর ছিল—সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল এবং ঢাকা হল। জগন্নাথ হল তখন সরকার অধিকার করে নিয়েছিলেন, রিকুইজিশন করে নিয়েছিলেন। তাই ঠিক জগন্নাথ হলের তখন কাজ বােধ হয় ছিল না, আমার যতদূর মনে পড়ে। এই তিনটা হলের সঙ্গে আমাদের সময় দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর আবার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চালু হলাে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের একই রকম কর্মধারা গৃহীত হলো। সেই নাটক, সেই বার্ষিকী। আমি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বার্ষিকীতে গল্প লিখেছি। আরাে নানা রকম কাজ হতাে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এবং হল ছাত্র সংসদের বাইরে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। তার নাম সংস্কৃতি সংসদ। সেটিই ছিল অনেকদিন পর্যন্ত ছাত্রদের একমাত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন এর সভাপতি ছিলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনি অচিরেই, বছর খানেকের মধ্যে শিক্ষক হয়ে গেলেন। শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পরেও সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি বেশ কিছুদিন থাকলেন।

পরে অন্য কারো হাতে দিয়ে দিলেন। এই সংস্কৃতি সংসদ ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার একটা প্রধান ক্ষেত্র এবং এই সংস্কৃতি সংসদের মধ্য দিয়ে আমরা নানা রকম প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার চর্চা করতে পেরেছি। আজকে যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ অকার্যকর হলে ছাত্র সংসদ নেই তখন আমার এই ভেবে খুবই কষ্ট হয় যে, আমরা ছাত্র সংসদে জীবন গঠনের যে উপকরণ খুঁজে পেয়েছিলাম, তার থেকে এখনকার ছাত্ররা বঞ্চিত হচ্ছে।

আর একটা কথা বলি, এই হল ছাত্র সংসদের উদ্যোগে নিয়মিত অনুষ্ঠানের। বাইরেও অনেক কিছু হত। একটা অনুষ্ঠানের কথা বলি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ঢাকায় এসেছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল—এই দুই হলেই তাকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তাঁকে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়। তিনি দুই হলেই বহুক্ষণ ধরেই তাঁর বাজনা বাজিয়েছিলেন এবং আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। এমনকি শহরের মানুষও যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত নয় তারাও ওস্তাদ আলাউদ্দিনের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন। তো এরকম কিছু-কিছু ব্যাপার হতো যেগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য। এখন সেই দিনগুলো অনেক দূরের বলে মনে হয়।

আমার সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ আমি করলাম। আমি নিজের অংশগ্রহণের কথা বলছি, হলের কথা বলেছি। তারপর ডাকসু ম্যাগাজিনে লিখেছি এবং এই সমস্ত সাংস্কৃতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করা। আমাদের বাংলা বিভাগে একটা আলাদা সংসদ ছিল, সেটা মানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফিসিয়াল তার কোনো রিকগনিশন ছিল না কিন্তু আমরা নিজেরা এটা গড়ে তুলেছিলাম। আমরা সেমিনার চালাতাম, আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম এবং আমাদের দেখাদেখি কোন কোন বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু আমাদের বিভাগে খুব জমকালােভাবে হতাে। এইটা বলে আমার কথা শেষ করি। আমিও বলতে পারি, আই অলসো র‌্যান অর্থাৎ আমি অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সেইটা বড় কথা না; বড় কথা হচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার যে পরিবেশ ছিল, সেই পরিবেশ সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া এবং জাগতিক কর্মকাণ্ডের জন্য খুব অনুকূল ছিল।

ভাষা আন্দোলনের কথা একটু বলি। ভাষা আন্দোলনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আগে। আমি যখন কলেজে পড়ি। ওই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আমার যে অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিকথায় ওটার সবটা আছে। ‘কাল নিরবধি’-তে সবটা আছে। ওখানে বিস্তারিত আছে।

সংস্কৃতিচর্চার ব্যাপারে এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা যদি বলো তাহলে। আমি বলব যে, নিশ্চয়ই এটার অবনতি হয়েছে। কেননা, আমি মনে করি যে হল এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ থাকা খুবই জরুরি। সেইটা না থাকলে ছাত্রদের সুকুমার বৃত্তি বিকাশের পথ সুগম হয় না। এখন হয়তো তোমরা ডিবেটিং ক্লাব করাে বা ড্রামা ক্লাব করাে, কিন্তু আমি তাে নাটক হতে দেখি না। ডিবেট-টিবেট কিছু হয়, আমি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তেমন দেখি না। হ্যা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে অনেকটা এবং তাতে তোমাদের ক্ষতি হয়েছে; এটাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। আমরা শিক্ষকরাও খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কারণ ছেলে মেয়েদের কি ধরনের প্রতিভা সেটা আমরা বোঝার সুযোগ পাই না এবং সেই প্রতিভা বিকাশে আমরা কোন ভূমিকা রাখতে পারি না। এইটা অমািদের সবার ক্ষতি।


সর্বশেষ সংবাদ