বাবার অনুপ্রেরণায় আজ তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

এ যুগে জ্ঞানের আলো ফেরি করা একজনের কথাই আমাদের চোখে ভাসে, তিনিই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। লিখেছেন- আবদুল্লাহ আল মোহন

পরম শ্রদ্ধার মানুষ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর এই মানুষটর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক। ষাটের দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি, লেখক হিসেবেও পরিচিত। সে সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি একজন সুবক্তা। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা বাংলাদেশে আলোকিত মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। অসম্ভব সফল এই মানুষটির আজকের অবস্থায় আসার পেছনের মূল কারিগর শিক্ষক পিতা।

পিতার অনুপ্রেরণাতেই বই চিনেছিলেন। আর সেই থেকেই নানান ভাবনার খোলনলছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আনন্দে বিশ্বাসী, আস্থাবান মানুষ। আর সেই সঙ্গে অসম্ভব স্বাপ্নিক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনেক প্রজ্ঞান অনুভব, ভাবনার কথামালা সমাজকে আলোড়িত, আলোকিত করে। ‘বি¯্রস্ত জর্নাল’-এ তিনি তাই অকপটে লিখেছেন, ‘এদেশে কারো উপকার করতে যাওয়াই ভোগান্তি। কারো জন্যে যে কিছু করে না, সে এদেশে জনপ্রিয়। যে ক্ষতি ছাড়া আর কিছু করে না সে প্রাতঃস্মরণীয়।’ কিংবা, ‘অজ্ঞনতার চেয়ে ধর্মহীনতা আর কিসে? অশিক্ষিত মানুষের আল্লাহও অশিক্ষিত।’ অথবা, ‘সাধারণ মানুষ ঝগড়া করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে, আলোকিত মানুষ মতবাদ স্তরে।’


সাহিত্যবোদ্ধা, প-িতদের মতে পৃথিবীতে ট্র্যাজেডির প্রথম স্রষ্টা গ্রিক নাট্যকার এসকিলাস, যিনি মানব জীবনের উত্থান-পতনময় অগ্রযাত্রাকে দেখেছিলেন এক সুগভীর নাটকীয় দৃষ্টিতে। ‘শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস’ নাটকে জ্ঞান ও শুভবুদ্ধির ওপর হৃদয়হীন শক্তির চিরকালের নির্যাতন যেভাবে অঙ্কিত হয়েছে, ঠিক তেমনি, নিগ্রহ ও লাঞ্ছনায় বিস্বস্ত হয়েও প্রেম, প্রজ্ঞা ও মানবতার জন্যে মানুষের চিরন্তন আকাক্সক্ষা এবং ঐ লক্ষ্যে তার অপরাজিত সংগ্রামের মহিমা ও কাহিনীও স্থান পেয়েছে। এই নাটকের নায়ক প্রমিথিউস সেই প্রেম, প্রজ্ঞা, শুভবুদ্ধির পরাভবহীন সংগ্রাম মহিমারই কালোত্তীর্ণ প্রতিনিধি। প্রমিথিউস যখন বলেন, ‘আমি সেই নির্বোধ প্রেমিক যে নিজের হৃদয়ের অনুকম্পার সততায় আগুনের মূল উৎস খুঁজে পেয়ে, চুরি করে সে আগুন, মানুষকে দিয়েছিল উপহার। সে আগুন, আজ মানুষকে দিয়েছে শক্তি, জয়, সফলতা অলৌকিক উদ্ভবের দিনে।’ তখন এ যুগে জ্ঞানের আলো ফেরি করা একজনের কথাই আমাদের চোখে ভাসে, তিনিই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।


‘জীবনের সমস্ত জায়গায় মাধুর্য খোঁজা’ মানুষ, চরম নৈরাশ্যের মধ্যেও প্রবল আশার উজ্জ্বল আলো দেখা সংশপ্তক মানুষ, জনপ্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মুখচ্ছবি মনে ভাসলেই মনে পড়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে। যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, একটি আন্দোলনের নাম। এই আন্দোলন আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলন। স্বাধীন দেশকে গড়তে উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত উদার শক্তিমান মানুষ তৈরির স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা শুরু করেছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সেই কেন্দ্র এখন দেশের হাজারো ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। লাখ লাখ শিক্ষর্থী এর সঙ্গে যুক্ত। পাঠ্য বইয়ের গৎবাঁধা পড়াশোনার বাইরে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিকে শাণিত করার জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ে তারা। অংশ নেয় বিভিন্ন পাঠচক্রে। দেশি-বিদেশি চিরায়ত নানা ধরনের বই পড়ে তারা হয়ে উঠছে আলোকিত মানুষ। এদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব কর্মসূচিই গ্রহণ করে কেন্দ্র। মনের মধ্যে যে প্রদীপের সলতে পাকায়, আগুন দেয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সেই আশ্চর্য প্রদীপের শিখায় আলোকিত বাংলাদেশ খুব দূরে নয়।


আলোহীন, বিচ্ছুরণহীন ও অকর্ষিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্ধকারে সুপ্ত ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আলোকের ঝরনা ধারায় কচি প্রাণ, অসীম সম্ভাবনাকে জাগিয়ে দিতে, ভরিয়ে দিতে, তাদের ভেতরকার কলুষতাকে ধুইয়ে দিতে চেয়েছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আর তাই পুরোপুরি অর্থহীন, শুধুমাত্র বেতনভোগী একজন শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ জীবন কাটাতে চাননি বলেই এই নিঃস্ব পরিবেশের ভেতর বাস করে একটা সৃজনশীল, কল্পনাসমৃদ্ধ অনাবিল আনন্দভুবনে আমাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার, সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জার্নালে লিখেছেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আসলে লক্ষ্য কী, এ নিয়ে নানান লোকের কাছে নানান কথা বলি। কিন্তু আমি তো জানি এই কেন্দ্রের সামনে আজ যদি সত্যিকার করণীয় কিছু থাকে তবে তা হচ্ছে দুটো: এক, আজকের তরুণদের অর্থাৎ আগামী দিনের মানুষদের বড় করে তোলা; দুই, তাদের সংঘবদ্ধ জাতীয় শক্তিতে পরিণত করা।’ ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লক্ষ্য কিন্তু সামান্য। তা হলো, ‘আরও একটু ভালো’। জীবন, সৌন্দর্য, বাস্তবতা ও সংগ্রামের নিরন্তর কর্ষণের ভেতর থেকে শক্তিমান মনুষ্যত্বে জেগে ওঠার মূল কথাও কিন্তু ঐটিই: ‘আরও একটু ভালো’। এই পৃথিবী ‘আরও একটু ভালো’র কাছেই চিরকাল নিরাপদ; কোনো মতবাদ বা বিশ্বাসের কাছে নয়।’

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সম্পর্কে স্যার বলেন- বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কোন গৎবাঁধা, ছক-কাটা, প্রাণহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সপ্রাণ সজীব পরিবেশ- জ্ঞান ও জীবন সংগ্রামের আনন্দ-দ্বৈরথে নিরন্তর অবগাহন সেরে সম্পূর্ণতর মনুষ্যত্বে ও উন্নততর আনন্দে জেগে ওঠার এক অবারিত পৃথিবী। এক কথায়, যারা সংস্কৃতিবান, কার্যকর, ঋদ্ধ মানুষ- যারা অনুসন্ধিৎসু, সৌন্দর্যপ্রবণ, সত্যান্বেষী; যারা জ্ঞানার্থী, সক্রিয়, সৃজনশীল ও মানবকল্যাণে সংশপ্তক- বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাদের পদপাতে, মানস বাণিজ্যে, বন্ধুতায়, উষ্ণতায় সচকিত একটি অঙ্গন।


আজকের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছেন তার পিতা অধ্যক্ষ আযীমউদ্দিন আহমদ। সায়ীদ স্যার বলেন, ‘আব্বা ছিলেন আমার কাছে বড় জীবনের আদর্শ। আব্বার মর্যাদা আর সম্ভ্রমের অবস্থা আমাকে শিক্ষক হতে উদ্বুদ্ধ করে। সারা অস্তিত্ব শিক্ষক হওয়ার নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে। মনে হয় পৃথিবীতে শিক্ষকের চেয়ে বড়কিছু কোথাও নেই। ... বৈষয়িক লিপ্সা তার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তার প্রধান আনন্দ ছিল শিক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করায়, বিদ্যায়তনের পর বিদ্যায়তন গড়ে তোলায়। ...ঘর সংসারের কোনো অস্তিত্বই যেন আব্বার কাছে নেই। মা আমার মধ্যেও আব্বার ঐ একই চরিত্র দেখতে পেয়ে দুঃখ করেন। টাকাপয়সার ব্যাপারে ঐ একই অনাগ্রহ। দিনরাত কেবল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। পুরনো দুঃখটা চাগিয়ে ওঠে তার। বলেন : ‘সেই বাপের ধারা পাইছে গো। নিজেগো জন্যে একটু মায়াদয়া নাই।’ ...মানুষের ঘরে জন্ম নেয় সন্তান। কেউ মেধাবী, কেউ মাঝারি, কেউ নির্বোধ। এরা জন্মায় জৈবিক ধারাবাহিকতায়। কিন্ত মানুষের আত্মার প্রকৃত সন্তান হয় কজন? ক’জনের মধ্যে পিতামাতা তাদের স্বপ্নের সত্যিকার সম্প্রসারণ দেখতে পায়? ...ছেলেমেয়েদেরও তো স্বপ্নের বাবা-মা আছে, যে বাবা-মাকে পেলে সন্তানের ভেতরকার কনকপ্রদীপ অলীক প্রভায় জ্বলে ওঠে। আমি সেই বাবাকে পেয়েছিলাম। সেই শিল্পী, শিক্ষক, আদর্শবান, প্রজ্বলিত পিতাকে। আমার প্রথম জীবনের স্বপ্নকে তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছিল আমার এক বিরাট পাওয়া। আমার দুরন্ত শৈশব যে বিপথগামী হয়ে নৈরাজ্যের মধ্যে নষ্ট হয়নি, সে হয়তো তারই কারণেই। আব্বার ব্যক্তিগত নৈতিকতা, উঁচুমাপের আদর্শ, সামাজিক মর্যাদা আমাদের সামনে এক উচ্চতর জীবনের আদর্শ দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, যে আদর্শ থেকে নিচে নামা সম্ভব ছিল না। ...আব্বা একা একা যে ঘরটায় পড়াশোন করতেন তাকিয়ে দেখতাম ঘরের পাঁচদিকের দেয়ালগুলো বইয়ের সার-সার উঁচু আলমারিতে ঠাসা, তাতে রঙবেরঙের অজ¯্র নয়ন-লোভন বই। চারপাশে বইয়ের এমন প্রাণবন্ত বিশাল সমারোহ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। বইয়ের বিশাল জগৎটা একটা আনন্দিত রঙবেরঙের ভুবনের মতো চারপাশ থেকে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সেদিন পলকের জন্য অবাক হয়ে দেখা বইয়ের সেই ভুবনমোহন বিপুল রূপটি যেন আমার সারা জীবনের নিয়তি হয়ে গেল। সেই ছোট্ট বয়সে যে অনবদ্য বিশাল গ্রন্থভা-ারকে আমি আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম সারা জীবন তাকেই হয়তো আমি খুঁজে বেরিয়েছি। অমনি দৃষ্টিনন্দন সুশোভন স্বপ্নেভরা বই দিয়ে আমার চারপাশকে ভরে তুলতে চেষ্টা করেছি।’


নিজের নানা কর্মকা- নিয়ে স্যার ক’বছর আগে জানান, ‘একেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি : গত বত্রিশ বছর ধরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে এই যে বিপুল গ্রন্থসম্ভার গড়ে তুলতে নিয়োজিত রইলাম-এ কেন? এ কি কেবলি বিবেক যন্ত্রণা? জাতীয় সমৃদ্ধির স্বপ্ন? একটা অন্ধকার জাতির জন্য অমৃতলোক রচনার আকুতি? হয়তো তাই। হয়তো কেন, নিশ্চয় তাই। তবু নিজের অবচেতন লোককে যখন জিজ্ঞেস করি তখন মনে হয় এ হয়তো এসবের চেয়েও আরও বেশি কিছু। আরও রহস্যময় কিছু। হয়তো সেই দূর ছোট্ট শৈশবে সেই ছোট্ট ঘরটার মধ্যে বইয়ের যে সম্পন্ন আর অপরিমেয় জগৎকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম, লাইব্রেরি-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই জগৎটাকেই গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। মানুষ হয়তো এমনটাই করে। সারা জীবন ধরে নিজের শৈশবটাকেই বড় আকারে পুনঃনির্মাণ করে।’


নিরন্তর নানা ব্যস্ততার মাঝেও সাহিত্যচর্চায় নিরলস সাধক তিনি। সাহিত্য সাধনাকে আরাধনার মতো করে বিভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্যের সেবা করে যাচ্ছেন। নাছোড় প্রেমিকের মতো এখনো তিনি সমান সক্রিয়, প্রতি বছর লিখে চলেছেন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের নতুন নতুন বই। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, অনুবাদ, জার্নাল, জীবনীমূলক বই ইত্যাদি মিলিয়ে তার গ্রন্থভা-ারও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বেরিয়েছে রচনা সমগ্রও। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৪০টি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি: দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, মৃত্যুময় ও চিরহরিৎ, নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, বিস্বস্ত জর্নাল, সংগঠন ও বাঙালি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি, বহে জলবতী ধারা, আমার উপস্থাপক জীবন, শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস (অনুবাদ) ইত্যাদি। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কামারগাতি পৈতৃক নিবাস হলেও তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪০ সালের ২৫শে জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে নানা বাড়িতে। লেখাপড়া করেছেন পাবনা জেলা স্কুলে, বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। শিক্ষকতাও করেছেন স্বনামধন্য ঢাকা কলেজসহ দেশের সেরা একাধিক কলেজে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের পাশাপাশি সায়ীদ স্যার জড়িত আছেন পরিবেশ দূষণবিরোধী আন্দোলনে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ আন্দোলনে এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের আশাবাদ নিয়ে জড়িত হয়েছেন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’-এর একজন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যসহ আরো নানাবিধ সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গে। আর তাই শিল্প সাহিত্যের পাশাপাশি সমাজসেবায় অবদানের জন্যও পেয়েছেন দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি: জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৭), রোটারি সিড পুরস্কার (১৯৯৯), বাংলাদেশ বুক ক্লাব পুরস্কার (২০০০), র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার (২০০৪), একুশে পদক (২০০৫), শেলটেক পদক (২০০৬), ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কারেও ভূষিত হন।


সায়ীদ স্যারের মতে, জীবন বহমান, জলবতী ধারার মতোই; কিন্তু মানুষের জীবনের একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সে শুধু বয়েই চলে না, নিজের গতিপথের দিকে তাকাতেও পারে। একই সঙ্গে একটা জীবন যাপন করা আর সেই যাপিত জীবনের স্মৃতিরচনা করা সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে। জীবনানন্দ লিখেছিলেন: ‘পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পা-ুলিপি করে আয়োজন।’ প্রবলভাবে রঙের মানুষ, প্রিয় মানুষ, প্রিয় স্যারকে আবারো জানাই নিরন্তর শুভেচ্ছা, বিনম্র শ্রদ্ধা। স্যারের আগামী দিনগুলো সুস্থ ও আনন্দময় কাটবে, সেই মঙ্গল কামনা করি নিরন্তর।
১৯৪০ সালের ২৫শে জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তার পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৫৫ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খ-কালীন প্রভাষক হিসেবে। পরে তিনি সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবন শুরু করেন। রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে (বর্তমানে ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ) যোগ দেন। এই কলেজে তিনি দু’বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে ঢাকা কলেজে যোগদান করেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা কলেজেই তার শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। তিনি যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান। ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন তার নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’ সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে। বাংলাদেশে টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকেই রুচিমান ও বিনোদন-সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। টেলিভিশনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় তিনি পথিকৃৎ ও অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব।


সর্বশেষ সংবাদ