আধুনিককালের সমাজ-সচেতন নিসর্গ কবি জীবনানন্দ

জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ  © ফাইল ছবি

জীবনকালে জীবনানন্দের দর্শন তার সমাজ বুঝতে পারেনি। তিনি একজন কাল-সচেতন ও ইতিহাস-সচেতন কবি ছিলেন। তা-ই কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে পাঠকদের আগ্রহ ও বিস্ময় প্রায় অন্তহীন। তার ব্যবহৃত শব্দের ভেতর থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং ইন্দ্রিয়াতীত সমস্ত অনুভূতির সন্ধান পাওয়া সম্ভব। সেই সব শব্দ থেকে বিচ্ছুরিত হয় একই সাথে আলো আর অন্ধকার। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ও তার অনন্যতা বিস্ময়কর। বিশেষত: কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবননান্দের নৈপুণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা’ পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে; নাড়া দিয়েছে তাদের জীবন বোধকে। 

অল্প বয়স থেকেই কাব্যচর্চার শুরু হয় জীবনানন্দের। স্কুলে ছাত্র থাকা অবস্থায় তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ব্রহ্মবাদী পত্রিকায়  বৈশাখ ১৩২৬/এপ্রিল ১৯১৯খ্রি:) প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’। ১৯৩০ সালের ৯ মে বিয়ে করেন রোহিনী কুমার গুপ্তের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। বিবাহিত জীবন তার মোটেই সুখের ছিল না। বিয়ের পর অনেকদিন কর্মহীন জীবন কেটেছে জীবনানন্দ দাশের। তাদের দু সন্তান মেয়ে মঞ্জুশ্রী ও ছেলে সমরানন্দ। সাংসারিক জীবনের পাশাপাশি জীবননান্দ দাশ বৈষয়িক জীবনে কখনো সফলতা পাননি । আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন বার বার। ভেবেছিলেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সাগরের জলে ডুবে মরবেন।

আজন্ম বাংলাদেশ প্রীতি ছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই বরপুত্রের। জীবনভর তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান মনে করেছেন বাংলাদেশকে। কবি হলেও অসংখ্য ছোটগল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন জীবননান্দ দাশ। কিন্তু জীবদ্দশায় এসব প্রকাশ করেননি তিনি। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উন্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত তার অসংখ্য পাণ্ডুলিপিতে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সতেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্য ধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

নিবিড় প্রকৃতি-চেতনা তার কবিতায় লাভ করেছে গভীর দ্যোতনা। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা- পুরাণের জগত তার কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্র রূপময়। বিশেষত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসুক্ষ্ম সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে তিনি রূপসী বাংলার কবি হিসেবে খ্যাত হয়েছেন।

আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতার চিত্রময়তা, যার সঙ্গে অনায়াসে ঘনিষ্ঠ বোধ করতে পারেন পাঠকরা। তার জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণও এটি। যে প্রকৃতির বর্ণনা জীবনানন্দ করেছেন, বাস্তবে তাকে পাঠক কখনো খুঁজে পায়নি। আর সেজন্যই পাঠক হারানো সেই সৌন্দর্যকে নিজের ভেবে আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছেন। তার উচ্চারিত অনেক শব্দ-চিত্র ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে পাঠকের। তার কবিতার সুর বিষণ্ণ, সবচেয়ে উজ্জ্বল যে রং তাও ধূসর, অথচ তা’ সত্ত্বেও জীবননান্দ দাশের কবিতায় পাঠক তার ব্যক্তিগত প্রণোদনার উৎস আজও খোঁজে। 

প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দ শিল্প জগতেও মূর্ত হয়েছেন, বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগর জীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয় রোধে জীবনানন্দ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি। তিনি ইতিহাস চেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সূত্রে বেঁধেছেন। স্বভাবে অন্তর্মুখী হলেও কবির দৃষ্টি ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরচেতনার শব্দ রূপ আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষা। সেজন্য তার কবিতায় তিনি ব্যবহার করেছেন ইম্প্রেশনিস্টিক রীতি, পরাবাস্তবতা, ইন্দীয় বিপর্যাস ও রঙের অত্যাশ্চর্য আঁচড়। জীবনানন্দ বাংলা কাব্য সাহিত্যের যে অজ্ঞাত পূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছিলেন তা জীবনানন্দের সমকালীন সময়ে খুব কম কাব্য রসিক কিংবা নন্দন তাত্ত্বিকরা বুঝতে পেরেছিলেন।

জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্য জীবনের সঙ্কট, নর-নারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌন সম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। প্রায় গল্প-উপন্যাসে আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ ঘটেছে জীবনানন্দ দাশের। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জীবনান্দের কবিতার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় বাঙালি জনতাকে তার ‘রূপসী বাংলা’ তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে। 

জীবনানন্দ ছিলেন আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি; তার বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫৩ সালে পুরস্কৃত হয়। জীবনানন্দের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থটি ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জীবনানন্দ দাশ অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

বিশ শতকের অন্য কোনো বাঙালি কবি পাঠকের কল্পনায় এমন প্রবলভাবে দাগ কাটতে পারেননি, যা জীবনানন্দ দাশ পেরেছেন। আজও তার কবিতার অলঙ্কার শব্দ ব্যবহার এবং অধুনা আবিষ্কৃত গদ্যের ভাষা ক্রমেই বিস্মিত করে চলেছে পাঠক হৃদয়। মৃত্যুর পরও সমকালীন বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রধান কবি হিসেবে আজও অধিষ্ঠিত জীবনানন্দ। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এই কবি জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের আজকের এই দিনে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence