সাহিত্যের রজতরেখায় সত্য-সুন্দরের বিশ্বাস এঁকেছেন আল মাহমুদ

মীর আবদুস শুকুর ‘আল মাহমুদ’
মীর আবদুস শুকুর ‘আল মাহমুদ’  © ফাইল ছবি

কবিতা যেন কীভাবে এসে যায়-এমন সরল করে যিনি তার সৃষ্টির কথা বলেতে পারেন তার সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ কই? আল মাহমুদ লাগাতার এক কবি, সময়কে যিনি লিখতে পারতেন অক্ষরের শক্তিতে। যেন যে কেউ চাইলেই তাকে পড়ে ফেলতে পারেন ইচ্ছেমতো। তিনি বিপ্লবের ইশতেহার লিখেছেন তার ‘সোনালী কাবিনে’। রবীন্দ্র উত্তর আধুনিক কবিদের মধ্যে শব্দের গাঁথুনি, জীবনবোধ আর বিশ্বাস, শব্দালংকারের নান্দনিকতা, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী মুনশিয়ানা তিনি চিত্রায়ন করেছেন তার কবিতার ক্যানভাসে। কবির কালের কলসের পরে ‘সোনালী কাবিন’কে অস্বীকার করতে পারেনি তার নিন্দুকেরাও। বিশ্বাসের কথা তিনি বলেছেন নিঃসংশয়ে:

আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।

উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহ্বল করতে পারেনি।

আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,

আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।

পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!

মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদের ‘আল মাহমুদ’ হয়ে উঠতে হয়ে উঠতে অক্ষরের শক্তি ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না তার। মফস্বল থেকে আসা, প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি-হীনতাসহ অজস্র যুদ্ধ নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক নিখাঁদ নক্ষত্র; তার অঙ্কিত রজতরেখা বাংলা সাহিত্য থেকে কখনো মুছে যাবে না। এটি তার বিশ্বাসের মতোই প্রবল ও শক্তিশালী। একমাত্র অক্ষরের জাদুতেই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছেন সর্বজনের কবি; প্রগতিশীলরাও মানতে বাধ্য তার কাব্য শক্তি। যদিও তার মতাদর্শ এবং বিশ্বাসের কারণে তাকে বারবার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়েছে। তবুও বিশ্বাসে যিনি এরনার্দো কাস্তেলের সাত হাজার কোটি আলোক বর্ষ দূরে সেই ‘তারকোলো’কে চিন্তা করতেন তাকে টলাতে পারে কে? বিশ্বাসের প্রশ্নে তিনি জবাব দিয়েছেন মেজাজি হয়ে। বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করলাম। এখন দাড়ি রেখে রাজাকার হয়ে গেলাম? তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ-ওয়ালারা তো আমাকে চাকরি দেয়নি। আর আমার অপরাধ কী? আমি তো সারা জীবন কবিতাই লিখে গেছি।’ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিহীনতা তাকে কোথাও আটকে রাখেনি। তিনি তো পাখিই হতে চেয়েছেন-

তোমরা যখন শিখছ পড়া

মানুষ হওয়ার জন্য,

আমি না হয় পাখিই হব,

পাখির মতো বন্য।

১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই প্রবল বর্ষণের এক রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামের এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ‘সোনালী কাবিনের’ এই শিল্পী। পিতা মীর আবদুর রব এবং মাতা রওশন আরা মীর। কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাইস্কুল এবং চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়াশোনা করলেও তার বেড়ে ওঠা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখির শুরু তার। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা বেগম আর তাদের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়েই ছিল তার জীবন-সংসার।

বিশ্বাসের প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘শোনো যুবক, আমার বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করতে এসো না। আমি সারা জীবনই বিশ্বাসী ছিলাম। হজের সময় কাবার দিকে তাকিয়ে আমি থরথর করে কেপে উঠেছিলাম।’ অনেকেই সমালোচনা করেন, আল মাহমুদ ১৯৯০’র দশকে ইসলামী ধর্মীয় বোধের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার কবিতায় ইসলামী চেতনার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। যদিও তিনি বিভিন্ন সময় তা অস্বীকার করেছেন। পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে চলতে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে আর কোনো গন্তব্য পাননি তিনি-

এখন কোথায় যাওয়া যায়?

শহীদ এখন টেলিভিশনে।

শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।

হাসানের বঙ্গ জননীর নীলাম্বরী বোনা

আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।

অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, 

কেননা:

আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে।  

তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই তার আত্মবিশ্বাস। লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে আল মাহমুদ লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করেছেন। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় জীবন দিয়েছেন; ‘কবির বিষয়’ এ বলেছেন-

আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষির বিষয়

চাষির বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর

কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন

সীমাহীন মাঠ।

চাষির বিষয় নারী।

উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।

পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।  

কম্পমান আবেগের দ্রাঘিমার হিসেব, দেশজ আর লোকজ চেতনায় লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহে আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলেছেন- 

সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী

যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;

ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।

আপন ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রিয়জনকে দিতে কোনো অর্থবিত্ত বা দেনমোহর গুরুত্ব বহন করে না, ভালোবাসা ছাড়া। তাই কবির এইসব পঙক্তিতে বিনয়ের উদার ব্যক্তিত্বে ভেসে উঠেছে ভালোবাসার কথামালা। ‘সোনালী কাবিন’এর সনেটগুচ্ছ কবি উপমা রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষাণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙ্ক্ষার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর আবেদন-

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না

তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা;  

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। সাম্য-মানসিকতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়নের সঙ্গে ধর্মের মিথলজির ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজ-নিষ্ঠ। যিনি শুরুতেও কবি এবং শেষেও তিনি কবিই তো। কবিদের তো মৃত্যু নেই। কবি মানে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, যিনি ধারণ করতে পারেন তার চলমান সময়কে। যখন দরকার হবে তখনই তার সৃষ্টির কাছে ফেরত আসতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে গণকণ্ঠের সম্পাদক হয়ে জেল খাটেন আল মাহমুদ। আবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুই তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন এবং অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে তিনি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব থেকে অবসর পান দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর। 

আল মাহমুদ পাখি হয়েছেন তার কবিতার ইচ্ছামাফিক। ২০১৯ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি দিনটি শুক্রবার ছিল।

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;

অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে

ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence