“প্রাচ্যের অক্সফোর্ড” বিতর্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু কথা

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২১ সালে উদ্যাপিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও নতুন জ্ঞানের অনুসন্ধান ও আবিস্কার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তব্য। পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গত এক’শ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি করে যাচ্ছে।

তবে এর বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অন্যন্য সাধারণ ও ব্যতিক্রমী অর্জন ও ভূমিকা রয়েছে। সেটি হলো বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যূদয়ে নেতৃত্বদানসহ বাঙালি জাতির সব মহৎ ও ইতিবাচক অর্জনে পুরোধার ভূমিকা পালন। এজন্য বলা হয় যে, বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একে অপরের পরিপূরক।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবগাঁথা, শতবর্ষের দ্বারদেশে এসে এখন তা কতটুকু অক্ষুন্ন আছে? এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন, আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড” অভিধাটি নিয়েও চলছে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক। এ বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্যই বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা।

বলে রাখা প্রয়োজন যে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার তারিখ সঠিকভাবে বলা না গেলেও ধারণা করা হয় একাদশ শতকের শেষ অথবা দ্বাদশ শতকের প্রথম দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। বিশ্ব র‍্যাংকিংয়েও অক্সফোর্ডের অবস্থান শীর্ষে। উপর্যুক্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড” বলা হয়।

তবে এরূপ অভিধা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এ বিতর্ক আগেও ছিল, কিন্তু শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে এ বিতর্কটির গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণ্ডলের বাইরেও বিদ্বৎ সমাজে, টেলিভিশন টকশোতে এ নিয়ে কথা হচ্ছে হর-হামেশাই। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও মন্ত্রী-এমপিগণও এ নিয়ে কথা বলেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন এবং কীভাবে জনমানুষের কাছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত হলো, এরূপ অভিধায় অভিসিক্ত হওয়ার পেছনেই বা কারণ কী? অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় অনেকেই তা না জেনেই বিতর্ক করছেন। অনেকে বলছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কালেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এরূপ অভিধায় অভিহিত করা উচিৎ নয় বলেও কাউকে কাউকে মন্তব্য করতে শুনা যায়।

২০১৬ সালে আমাদের জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড”- একথাটি সত্য নয়। একে তিনি একটি “কথিত কথা” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। তাঁর মতে, এটি লোকে বলে, আর বলতে বলতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদের এ কথায় আংশিক সত্যতা আছে, পূর্ণ নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলার সপক্ষে কোনো লিখিত প্রামাণ নেই বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও কোনো দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এরূপ অভিধা চালু করা হয়নি। তবে এমনি এমনি লোক মুখে এরূপ নাম চালু হয়ে গেছে- এ কথাটিও সঠিক নয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ২০১৯ সালের জুলাই মাসে টিএসসিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দিনও প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল না। তাঁর মতে, ব্রিটিশরা এরকম একটা বদনাম দিয়ে গেছে। এমন বক্তব্য কিন্তু আরো অনেকেরই আছে। এতো গেলো এক দলের কথা, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে অভিহিতকরণকেই অযৌক্তিক বলে মনে করছেন।

একদল মানুষ আছেন যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলাকে অসঙ্গত মনে করেন না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন এরূপ অভিধা পেলো সে সম্পর্কে তাঁদের সিংহভাগই ভুল ধারণা পোষণ করেন। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে একটি পত্রিকার খবরে দেখেছিলাম একজন বুদ্ধিজীবী বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা (ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত) কার্জন হলের নির্মাণশৈলীর সাথে ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্থাপনাসমুহের সাদৃশ্য থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়।

অনেকেই মনে করেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলার কারণ এর শিক্ষা ও গবেষণার উচ্চ গুণগত মান। বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বছরগুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকগণ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার উচ্চমান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে এ প্রতিষ্ঠান “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড” হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এ দৃষ্টিকোন বিবেচনা করে অনেকেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এখন আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতিটি প্রযোজ্য নয়।

কেননা তাঁদের মতে, শিক্ষা ও গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্য এখন আর নেই। গত বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছিল, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সেজন্য বলছি। এখানে লেখাপড়ার একটা ঐতিহ্য ছিলো। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর থেকে একটা শ্রেণি অস্ত্র হাতে নিয়ে নেমে পড়ল। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও বুঝা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ঐতিহ্যের অধোগতি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব র‍্যাংকিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের ক্রম অবনমনের ফলে এ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড সম্পর্কিত বিতর্কটি আরো প্রবল রূপ ধারণ করেছে।

দু’টো জিনিসের মধ্যে পারস্পরিক উপমা প্রদানের রেওয়াজ কোনো অস্বাভাবিক নয়। যখন দু’জন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো জিনিসের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যগত মিল পাওয়া যায়, তখন অনেক সময় দু’জন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্থান বা জিনিসের সাথে পারস্পরিক তুলনা করা হয়। যেমন আমাদের জতীয় কবি কাজী নজরুলকে ইংলিশ কবি পি.বি. শেলী ও লর্ড বায়রনের সাথে তুলনা করে “বাংলার বায়রন” ও “বাংলার শেলী” বলা হয়। মহাকবি ফেরদৌসীকে গ্রিক কবি হোমারের সাথে তুলনা করে বলা হয় “প্রাচ্যের হোমার”। বিখ্যাত মুসলিম চিত্রশিল্পী কামালউদ্দিন বিহাযাদকে রেনেঁসা যুগের বিশ্বখ্যাত ইতালীয় চিত্রশিল্পী রাফায়েলের সাথে তুলনা করে বলা হয় “প্রাচ্যের রাফায়েল।” এমন উদাহরণ আরো অনেক দেয়া যাবে।

উল্লেখ্য যে, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক তুলনা সংক্রান্ত অভিধা সবসময় দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে হয় না। অনেক সময় মানুষের মুখে মুখেও এর প্রচলন ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত হয়েছে প্রকৃতপক্ষে এভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের ঘোষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিতি লাভ করেছে- এমনটা নিশ্চিত করে বলার মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়? আমরা জানি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। লর্ড লিটনের ভাষায়- এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য বঙ্গভঙ্গ রদের “চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে” এবং লর্ড হার্ডিঞ্জের ভাষায় “রাজকীয় ছাড়” হিসেবে। যা’হোক পূর্ব বাংলার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯১২ সালে Nathan Commission গঠনের মাধ্যমে। তবে কলকাতা এমনকি পূর্ববাংলার উচ্চবর্ণ ও মধ্যবিত্ত হিন্দু ভদ্রলোকদের বিরোধিতা এবং সর্বোপরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিলম্বিত হয়। অবশেষে “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন”(The Sadlar Commission নামেও পরিচিত)-এর সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ প্রণীত The Dhaka University Act ( Act no XIII) অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশের ভিত্তি ছিল নাথান কমিশনের সুপারিশসমূহ। নাথান কমিশনের রিপোর্টের অন্যতম সুপারিশ ছিল প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি “আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়” (Teaching-cum Residential University)| কলকাতা কমিশন রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে পূর্বোক্ত নাথান কমিশন রিপোর্টের এ সুপারিশ বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল। তবে কমিটির সদস্য ও পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ফিলিপ জে হার্টগের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে ভাবনা কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। তিনি তাঁর প্রশাসনিক চাকুরি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই যুক্ত ছিলেন লন্ডন ইউনিভার্সিটির সাথে।

তাই হার্টগ চেয়েছিলেন প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য হবে লন্ডন, ম্যানচেষ্টার ও লীডস্ ইউনিভার্সিটির মতো আধুনিক ও নতুন প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। তবে তাঁর এ পরিকল্পনা সফল হয়নি। কলকাতা কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাথান কমিশনের পূর্বোক্ত সুপরিশটিই সামান্য পরিমার্জনসহ গ্রহণ করে। ফলে The Dhaka University Act অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই যাত্রা শুরু করে।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানকারী ও আবাসিক বৈশিষ্ট্য বহাল ছিল। কিন্তু ক্রম-বর্ধমান ভর্তির চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর আবাসিক চরিত্রটি পরিত্যক্ত হতে থাকে। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “অধিভূক্তি বা affiliating” কর্তত্ব ছিল না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একে সে ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। এতে পূর্ব বাংলার মাধ্যমিক ও তদুর্ধ স্তরের কলেজসমূহের ওপর থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্তি ক্ষমতার বিলোপ ঘটে।

এরূপ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ববাংলার মাধ্যমিক স্তরের ঊধ্বর্তন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষা ও আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে “শিক্ষা ও অধিভূক্তিকরণ (affiliating)” প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি বজায় না থাকলেও প্রতিষ্ঠাকালীন ঐতিহ্য এখনো অনেক্ষেত্রেই বহাল আছে। যেমন-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণ বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে পড়াশুনা করলেও শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম হলসমূহেই সম্পাদিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃত্বের মূল আধারও বলা যায় হলসমূহকেই। আবাসিক না হলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই কোনো না কোনো হলের সাথে যুক্ত থাকতেই হয়। একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরু দিকে প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর ও অ্যাসিসস্টেন্ট হাউজ টিউটরগণ সংশ্লিষ্ট হলের শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন শিক্ষা ও নৈতিক চরিত্রের বিকাশে সহায়তা করতেন। পদসমূহের নামকরণ থেকেই এটি বুঝা যায়।

উল্লেখ্য যে, সূচনালগ্নে হলসমুহে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের হল প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর ও অ্যাসিসটেন্ট হাউজ টিউটরগণ অনেকটাই আগলে রাখতেন। অভিভাবকদের থেকে দূরে থাকা শিক্ষার্থীদের তাঁরা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতেন। এখন হল প্রশাসন বাস্তবিক অর্থে শিক্ষার্থীদের জন্য এসব কাজ আর করেন না। তবুও ঐতিহ্য অনুযায়ী হল প্রশাসনের সাথে সূচনাকালীন পদবি নিয়ে হাউজ টিউটর, অ্যাসিসটেন্ট হাউজ টিউটরগণ কর্মরত আছেন। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সময়ই প্রত্যেক শিক্ষককে কোনো না কোনো হলের সাথে সংযুক্তি প্রদান করা হয়।

পুনশ্চ উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন Teaching-cum Residential যে বৈশিষ্ট্য ছিল তা গৃহিত হয়েছিল বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড ও ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালযের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করেই। এজন্য কখনো কখনো বলা হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল “অক্সব্রিজ শিক্ষা পদ্ধতি” (অক্সফোর্ড ও ক্যাম্ব্রিজের সংক্ষিপ্ত রূপ) অনুসরণে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে “প্রাচ্যের অক্সোফোর্ড” অভিধাটিই বহুল প্রচলিত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি সম্পূর্ণ আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বলেই যে একে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়- এ মতটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উচ্চগুণগত মানের বিবেচনাটিও এরূপ অভিধা প্রদানে বিবেচনায় থাকতে পারে, তবে এর পেছনে মূখ্য বিবেচনাটি কিন্তু অবকাঠামো ও শিক্ষাপদ্ধতির সাথে অক্সফোর্ডের সাদৃশ্য থাকার জন্য হয়েছে বলা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতির আলোর বাতিঘর। এটি সমগ্র বিশ্বে স্বনামে সুপরিচিত ও স্বনামেই ধন্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও ঐতিহ্যিক ইতিহাস। পৃথিবীর সব দেশই নিজস্ব ও বৈশ্বিক প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিরন্তর ভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও যে শত বছর ধরে এ কাজ করে যাচ্ছে তা আগেই বলা হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত অবস্থান আজ আর নেই-এমন অভিযোগ হর-হামেশাই শুনছি। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য আন্তজার্তিকভাবে স্বীকৃত বৈশ্বিক র‍্যাংকিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে- তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্মদানে গৌরবময় ভূমিকা পালনসহ এদেশের প্রায় সকল ইতিবাচক অর্জনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবেও খ্যাত হতো এ বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এ চরিত্রটিও অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে, তাতেও দ্বিমতের অবকাশ নেই।

নানা-সংকট, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনও স্বীকৃত। এখনো উচ্চশিক্ষা লাভে আগ্রহী তরুণদের একটি বৃহৎ অংশের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ-বিদেশে স্বনামে খ্যাত অনেক শিক্ষক, গবেষক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশের খ্যাতনামা বহু রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র পরিচালক এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক। প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরের জন্য উপযুক্ত মানব সম্পদ তৈরিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখনও বাংলাদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন স্নাতক ড. মুহাম্মদ ইউনুস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। এ গৌরব শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, গোটা বাংলাদেশেরও।

শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আগেই বলা হয়েছে যে, ২০২১ সালে জাতি উদযাপন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা শতবার্ষিকী। একই বছর পালিত হবে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ মহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে এটি বলা যায় যে, শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি এর বৈশিষ্ঠগত কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তনও ঘটেছে। শিক্ষার গুণগত মানের অবনতির অভিযোগটিও অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রাতিষ্ঠান হিসেবে আজও যেমন সক্রিয় এবং ভবিষতেও তা থাকবে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে শিক্ষা ও গবেষণা বান্ধব নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যে এর অতীত গৌরব, ঐতিহ্য ও সুনাম সমুন্নত রাখবে শতবর্ষী এ প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার অপর নাম। সকল সংকট ও সমস্যা মোকাবিলা করে এটি তার ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিচালিত হবে, এটিই সকলের প্রত্যাশা। আর “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড” হিসেবে এদেশের মানুষের কাছে এর যে পরিচিতি, তাও অটুট থাকবে যতদিন এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্তিত্ব টিকে থাকবে। কোনো তর্ক-বিতর্ক ও সমালোচনায়ই মানুষের মন থেকে তা মুছে ফেলতে পারবে না-এ আমার বিশ্বাস।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাবি। কাউন্সিল সদস্য, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি


সর্বশেষ সংবাদ