আহা, কি অসহায় আর দুর্ভাগা আমাদের শিশুরা!

আমি কয়েকজন বাবা মাকে চিনি যারা তাদের সমস্ত চাওয়া, পূর্ণ, অপূর্ণ, অর্ধ-পূর্ণ ও সম্পূর্ণ নতুন স্বপ্নের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন তাদের সন্তানদের উপরে; আর কেড়ে নিচ্ছেন তাদের শৈশব।

শিশুটির বয়স পাঁচ বছর। পড়ছিল বেশ ভালো, নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে। তবে তার মায়ের স্বপ্ন আরো ব্যাপক; তিনি ভাবছিলেন শিশুটির ভবিষ্যৎ নির্বিঘ্ন করতে হলে শুধু ভালোতে চলবে না-সবচেয়ে ভালো(!) স্কুলটিতে, নিদেনপক্ষে সবচেয়ে ভালোর একটিতে ভর্তি করতেই হবে এবং তা করতে হবে এখুনি! তাই পাঁচ বছরের শিশুটি নিয়মিত ভালো স্কুলে যায়; বাসায় ফিরে গেমস খেলতে খেলতে খাওয়া দাওয়া করে, টিভি দেখতে দেখতে জামা কাপড় বদল করে, অতঃপর পড়া মুখস্থ করতে করতে কোচিং ক্লাসে যায়; পুরোটা বিকাল ও সন্ধ্যা কোচিং ক্লাসের খুপরি ঘরে কাটিয়ে, বাসায় এসে, চিকেন ফ্রাই বা নুডলস খেতে খেতে বর্তমান স্কুলের বাড়ির কাজ করে। তারপর ক্লান্ত শিশু কার্টুন দেখতে দেখতে বিনোদনের কোটা পূর্ণ করে পরের দিনের জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়।

পরিচিত আরেকটি শিশুর মা হাইপ্রেশারের রোগী হয়ে যাচ্ছেন- ক্লাস টু এর বাচ্চা শতকরা নব্বই ভাগ নম্বর পেলেও, নিরানব্বই ভাগ কেন পাচ্ছে না-সেই দুশ্চিন্তায়!

ঘনিষ্ঠ আরেকজন আছেন, যার ছয় বছরের বাচ্চা নিয়মিত স্কুলের পাশাপাশি নিয়মিত গান, নাচ, ছবি আঁকার স্কুলে যেতে বাধ্য হয় এবং বাসায় হুজুরের কাছে পড়ে। বাচ্চা কাঁদলেও রুটিনের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই!

একজন অভিভাবকের গল্প শুনেছি, যিনি বাচ্চারা ৫ মিনিট খেললেও গালাগালি করেন; পড়া নিয়ে এতো অত্যাচার, মারধোর করেন যে, তার ক্লাস সেভেন পড়ুয়া বাচ্চার তীব্র এংজাইটি ডিজঅর্ডার আর পরীক্ষা ভীতির কারণে সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং এ পাঠাতে হয়েছে।

আর একটু বড় শিশুদের কথা বাদই দিলাম-তাদের জীবনে পরিচিত একটিই দৃশ্য-জীবন মানেই সকাল-সন্ধ্যা দৌড় আর দৌড়। আর বিনোদন মানেই ভিডিও গেমস, টিভি, ফোনের প্যাকেজ, ফেসবুক, প্রেম/প্রেমহীনতা, নেটে আসক্তি অথবা আরো তীব্র কোন কিছুতে আসক্তি!

আমার নিজের এবং পরিচিত অনেকের ছেলেবেলার সাথে মিলিয়ে দেখতে চাইলাম একটু- ক্লাস ফাইভের আগে কোচিং ক্লাস কি জানতাম না। বৃত্তি পরীক্ষার মাস তিনেক আগে থেকে বাসায় একজন শিক্ষক আসতে শুরু করলেন গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজি ব্যাকরণ শিখতে সাহায্য করতে। ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত ব্যাচে পড়েছি শুধু সকালবেলা, স্কুলে যাওয়ার আগের সময়টাতে-তাও শুধুমাত্র মৌলিক বিষয়গুলো-এখনকার মত বাংলা, ধর্ম, সমাজ, চারুকলা থেকে শুরু করে ১১ টি বিষয় নয়।

আমাদের বাবা মা কিভাবে যেন পড়া লেখাটাকে (পাঠ্য ও পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই) আমাদের কাছে সহজ ও সহজাত করে তুলেছিলেন, বইকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন। আমরা পড়তাম ঠিক ই- কিন্তু পড়ালেখা, বিশেষ করে ভাল ফলাফলমুখী বইয়ের বিদ্যা আমাদের শৈশব, কৈশোরের পুরোটা বেদখল করে নিতে পারেনি।

জীবনে যে পড়া, খেলা, দুষ্টুমি, মারামারি, আনন্দ, দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়া সবকিছুর সমন্বয় দরকার- একথা আমরা অনেক অভিভাবকই ভুলে যাই। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি- অনেকেই বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা, হাসিখুশি শিশুকাল যাপনের দিকে গুরুত্ব দেননা, বরং তাদের একটি ক্যারিয়ার-ওরিয়েন্টেড পড়ুয়া রোবটে পরিণত করতে চান।

আমাদের ছোটবেলায় খেলাধুলা, পড়াশোনা সমন্বয়ের সুযোগ ছিল। আমরা মফস্বলবাসী জনগণ স্কুলে গিয়ে ক্লাসের আগে, টিফিন পিরিয়ডে, কখনো কখনো ছুটি শেষে বিশাল স্কুল মাঠে দাপিয়ে খেলতাম গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, বৌছি, ব্যাডমিন্টন; আর শেষের দিকে টেবিল টেনিস। বাসায় ছিল ক্যারাম বোর্ড, দাবা এবং লুডো।

লুডোয় হেরে মারামারি করতাম/ ঝগড়া করতাম ভাই বোন /সমবয়সী প্রতিবেশীর সাথে। কাড়াকাড়ি করে পড়ে শেষ করতাম একের পর এক গল্পের বই। স্কুল লাইব্রেরি পার হয়ে অতঃপর পা রাখলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের দরজায়। সপ্তাহে দুইদিন ধারাবাহিক আর সাপ্তাহিক নাটক, কুইজ কুইজ, টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, শুক্রবারে নতুন কুঁড়ি, সিনেমা, দ্য গার্ল ফ্রম টুমরো, ম্যাকগাইভার, রোবোকপ, রবিবারে ছায়াছন্দ, মাঝে সাঝে কার্টুন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি, ঈদের সময় আনন্দমেলা -এই ছিল আমাদের টিভিটাইম।

আমরা বিজ্ঞান মেলার জন্য প্রোজেক্ট বানাতাম, দেয়াল পত্রিকা বানাতাম হাতে লিখে, শিশু একাডেমীর তাবৎ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতাম, দল বেঁধে আড্ডা দিতাম, স্কাউটিং করতাম , বন্যা হলে ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করতাম ;প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি খুব ভোরে যেতাম প্রভাত ফেরিতে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আসার একমাস পনের দিন আগে থেকে পড়ে যেত সাজসাজ রব।পিটি প্যারেড আর প্রদর্শনীতে বয়েজ স্কুলকে হারিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা -কি নির্ভেজাল উত্তেজনা আর উদ্দীপনার দিন ছিল সেইসব! কত প্রলম্বিত প্রগাঢ় শৈশব ছিল আমাদের-কি অপাপবিদ্ধ কৈশোর!

জেএসসি, পিএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, জিপিএ ফাইভ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ক্যারিয়ার, সাফল্যের অনন্ত জাগতিক দৌড় এতো ভয়াবহ ছিল না। অন্তত ক্লাস ওয়ান, প্রি-স্কুল থেকেই শৈশব চুরি হওয়া শুরু হত না।

আমাদের অধিকাংশের বাবা মায়েরা বোধহয় এতো বেশি সচেতনই (!) ছিলেন না- তাই সন্তানের ক্যারিয়ার বিষয়ক দুশ্চিন্তা একটু দেরিতেই শুরু করতেন। অন্তত দুবছর বয়স হতে না হতেই, স্কুল, টিচার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতেন না- ব্যতিক্রম তো নিশ্চয়ই ছিলেন-তবে অনেক কম।

তবু আমাদের অনেকেরই ছেলেবেলা ছিল ছেলেখেলাময়; বছরে কয়েকবার দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি-পুকুরে দাপাদাপি, অবাধ দৌড়, কাড়াকাড়ি আদর, ব্যাপক খানাদানা, পড়ালেখাহীন উদ্দাম দিন রাত্রির স্মৃতিময়। আমাদের সম্পর্কগুলো ছিল অনেক বেশি মানবীয়, টুকরো টুকরো সরলতা ছিল জীবনের অলিতে গলিতে। কত দীর্ঘ দিন রাত্রি পার হয়ে আমরা পৌঁছেছি বড়বেলার কানাগলিতে।

আহা, কি অসহায় আর দুর্ভাগা আমাদের শিশুরা! আর কি বোকা তাদের দৌড়বিদ অভিভাবকেরা! (ফেসবুকে থেকে সংগৃহীত)

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ