আয়া সোফিয়া জাদুঘর নয়, মসজিদ

  © টিডিসি ফটো

এক.

আয়া সোফিয়া কী? ভাবছেন কোনো নারীর নাম? এমন কিছু নয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে তামাম দুনিয়া হয়ত জেনে গেছে এর ইতিহাস। নতুন করে সামনে এসেছে মসুলমানদের ইস্তাম্বুল বিজয়ের এক সোনালী অধ্যায়। যারা একটু ইতিহাস সচেতন তারা হয়ত পূর্বেও জেনে থাকবেন, এ নাম শুনেও থাকবেন। কয়েক দিন যাবত আয়া সোফিয়াকে নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিডিয়া হাউজগুলোও লিখছে ব্যাপক হারে। হচ্ছে তর্ক-বির্তক। বলা যায় যারা বাইরের দুনিয়ার টুকটাক খোঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে এটি এখন টক অফ দি ওয়াল্ড।

৫৩৭ সাল। তৎকালীন বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান বসপরাসের পশ্চিম তীরে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের (বর্তমান ইস্তাম্বুল) গোল্ডেন হর্ণ নামক জায়গায় একটি বিশাল গির্জা নির্মাণ করেন। যার নাম এই আয়া সোফিয়া। সেই সময়ে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় দালান ও গির্জা। ৫৩৭ থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত আয়া সোফিয়া ছিল ইস্টার্ন অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল। অর্থাৎ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের প্রধান তীর্থস্থান। এখানেই অর্থোডক্স চার্জের প্রধান থাকতো। কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা এটিকে দখল করে ১২০৪ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক চার্জ হিসাবে ব্যবহার করে।

পরে ১২৬১ সাল থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত আয়া সোফিয়া আবারও অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল হিসাবেই ব্যবহৃত হয়।বাইজেন্টাইন শাসকরা এই ক্যাথিড্রালেই তাদের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক গুলো করতেন। অর্থাৎ আয়া সোফিয়া বাইজেন্টাইন শাসকদের ধর্মীয় ও রাজনীতির তীর্থ স্থানে পরিনত হয়। এটি ছিল তাদের গির্জার চেয়েও বেশি কিছু। ৫৩৭-১৪৫৩ এই প্রায় এক হাজার বছর আয়া সোফিয়া কখনো অর্থোডক্স, কখনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের গির্জা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

দুই.

সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আসে ১৪৫৩ সালে।যখন অটোমান সুলতান (ওসমানীয় বংশের) মেহমেদ (দ্বিতীয়) বাইজেন্টাইন শাসকদের হাত থেকে যুদ্ধে কনস্টান্টিনোপল দখল করেন। কনস্টান্টিনোপল দখল করেই সুলতান মেহমুদ তাঁর সৈন্য সামন্ত নিয়ে আয়া সোফিয়ায় শুকরিয়া নামাজ আদায় করেন এবং এটির সাথে আরো চারটি মিনার বানিয়ে পরবর্তীতে গির্জা থেকে মসজিদে পরিনত করেন।

১৬১৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত যখন তুরস্কের ব্লু মস্ক নির্মিত হয়নি তখন পর্যন্ত এই আয়া সোফিয়া মসজিদই ছিল তুরস্কের ইম্পেরিয়াল মস্ক। ১৪৫৩ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো বছর আয়া সোফিয়া মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই পাঁচশো বছর এই মসজিদটি অটোমান শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনাও ভূমিকা রেখেছে।

এটাকে কেন্দ্র করেই চলত অটোমান শাসকদের রাজনৈতিক কার্যক্রম। খ্রিস্টানরাও তাই করেছে। এজন্যই অটোমান শাসকদের কনস্টান্টিনোপল বিজয় বিশ্বে মসুলমানদের একটি বড় জয়, খ্রিস্টান তথা পাশ্চাত্য দুনিয়ার একটি পরাজয়ের প্রতীক। মসজিদ বানানোয় খ্রিস্টান দুনিয়া প্রতিবাদ মুখর হওয়ার এটিও একটি কারণ হতে পারে।

মুসলমানরা যেহেতু বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করে কনস্টান্টিনোপল দখল করে সেই থেকে আয়া সোফিয়া মুসলমানদের সম্পত্তি হিসেবেই গণ্য হয়। কিন্তু নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয় ১৯৩৪ সালে, যখন আধুনিক তুরস্কের সেকুলার রাষ্ট্রনায়ক কামাল আতাতুর্ক পাশার মন্ত্রী পরিষদ একটি বিশেষ ঘোষণা বলে আয়া সোফিয়া মসজিদকে জাদুঘরে রুপান্তরিত করেন। অসংখ্য মসজিদ তখন বন্ধ করে দেয় কামাল পাশার সরকার। সেই সময় থেকে চলে গেছে ৮৬ বছর। হয়েছে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও বক্তৃতা কিন্তু আয়া সোফিয়াকে আর মসজিদে পরিনত করা সম্ভব হয়নি।

অবশেষে তুরস্কের বর্তমান ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তুরস্কের ইসলামপন্থীরা চাইছিল আয়া সোফিয়া আবারও তার পাঁচশো বছরের মসজিদের পুরনো পরিচয় ফিরে পাক। তাই হলো গত ১০ জুলাই ২০২০ এ, এদিন এক ঐতিহাসিক রায়ে তুরস্কের প্রশাসনিক আদালত কাউন্সিল অব স্টেট ঘোষণা করে আয়া সোফিয়া জাদুঘর নয়, মসজিদ। রায়ে বলা হয়- Buildings conversion to a museum by modern Turkey's founding statesman was illegal (al Jazeera).

১৯৩৪ সালের কামাল আতাতুর্কের আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর বানানোর আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে। এর পরেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এক ঘোষণায় আয়া সোফিয়াকে তুরস্কের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ন্যাস্ত করেন এবং মসজিদ হিসাবে ঘোষণা দেন। আগামী ২৪ জুলাই ২০২০ থেকে আয়া সোফিয়ায় আবারও নামাজ অনুষ্ঠিত হবে এবং এখন থেকে এটি একটি মসজিদ হিসাবেই পরিগনিত হবে। রায়ের সাথে সাথেই মসজিদ প্রাঙ্গণে আজান হয়েছে, শত শত মানুষ আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছে।

প্রথমে অর্থোডক্স গির্জা হলেও এটি পরবর্তীতে ক্যাথলিক গির্জা থেকে আবারো অর্থোডক্স গির্জায় পরিনত হয়। মসুলমানরা পাঁচশো বছর মসজিদ হিসাবে ব্যবহার করার পর ৮৬ বছর যাবত ছিল জাদুঘর এবার আবারো মসজিদে পরিনত হল। এ এক ঐতিহাসিক যাত্রা পথ। যেখানে লিপিবদ্ধ মসুলমানদের বীরত্বের অনেক মহাকাব্য। সুতরাং কিছুটা খারাপ অন্যদের লাগা অস্বাভাবিক নয়।

তিন.

রাশিয়া, গ্রীস, আমেরিকা এবং জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো অবশ্য এই রায়ের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা বলছে এই ডিসিশন ডিভিশন বাড়াবে। গ্রীসের প্রতিক্রিয়াও যথেষ্ট, কারণ গ্রীসের লাখ লাখ অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কাছেও এটি পবিত্র স্থান। ইউনেস্কো আয়া সোফিয়াকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বা ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে সুতরাং মসজিদ ঘোষণাটা তারাও মানতে পারছেনা।

কিন্তু তুরস্ক এই মসজিদকে নিয়ে বিশ্বের মোড়লদের নাক গলাতে বারণ করেছে। তুরস্ক বলছে এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।এ ব্যাপারে বাইরের কোনো রাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপকে তুরস্ক তার স্বার্বভৌমত্বের উপর হুমকি হিসাবে দেখছে এবং এসব অভিযোগের কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। এরদোয়ান বলছেন তার দেশেও ৪৩৫টি গির্জা ও ইহুদিদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সিনাগগ রয়েছে। সব ধর্ম স্বাধীন ভাবে পালন করার অধিকার তুরস্কে আছে। কিন্তু আয়া সোফিয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর রয়েছে এক বিজয়ের ইতিহাস। যে ইতিহাস মসুলমানদের সোনালী অতীত মনে করিয়ে দেয়।

মসুলমানরা কনস্টান্টিনোপল দখল করার পর থেকে এর নাম রাখে ইস্তাম্বুল। আলেকজান্ডার একবার বলেছিলেন পৃথিবী একটা দেশ হলে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) হত তার রাজধানী। এত সুন্দর আর প্রাচুর্যে ভরা ছিল ইউরেশিয়ার এই শহর। এক হাজার বছরের একটি গির্জাকে কেন মসলমানরা মসজিদ বানাতে গেল সেই বিতর্কও কেউ কেউ তুলছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি তো অটোমান মসলিম শাসকদের। তারা এটিকে তাদের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে মসজিদ বানিয়েছেন এবং মসজিদ বানাবেন এটাই স্বাভাবিক।

যার সম্পদ সে কী তাকে জাদুঘর নাকি মসজিদ বানাবে সেটা তারই এখতিয়ার। স্পেনেওতো অনেক মসজিদকে পরবর্তীতে গির্জা বানিয়েছে খ্রিস্টান শাসকরা। নজীরতো আছে। কিন্তু পাশ্চাত্যে দুনিয়া আয়া সোফিয়াকে মসজিদ বানানোটা এক ধরনের রাজনৈতিক পরাজয় হিসাবে দেখে। হয়ত বাইজেন্টাইনদের মসুলমানদের কাছে পরাজয়ের ক্ষত তাদেরকে আজও খুব কষ্ট দেয়। অবশ্য দেওয়ারই কথা। যে মুসলমানদের তারা সারা দুনিয়ায় আজ দৌড়ের উপর রাখছে সেই মসুলমানরাই আয়া সোফিয়াকে মসজিদ বানিয়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিল?

চার.

কেউ কেউ এও বলছেন আয়া সোফিয়াকে মসজিদ ঘোষণা করে বাবরি মসজিদ ও আল আকসা মসজিদ নিয়ে মসুলমানদের কথা বলার নৈতিক অধিকার হারালো! এরদোয়ান, মোদি, নেতানিয়াহুর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকলো না! আসলেই কি তাই? তুরস্কের একটি জাদুঘরকে মসজিদে পরিনত করার রায়ে পাশ্চাত্য দুনিয়া এত সরব হলেও তারা কেন পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন, কাশ্মীরে দমন পীড়ন কিংবা ভারতের এনআরসির বিরুদ্ধে কথা বলেন না? আয়া সোফিয়া মসজিদকে কেন্দ্র করেই পাঁচশো বছর তুরস্কে মুসলিম শাসকদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলেছে।

সুতরাং এটি শুধু একটি মসজিদ নয়। এর চেয়েও বেশি কিছু। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যে কোনো ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার যেমন অধিকার আছে ঠিক তেমনি মসুলমানদের অতীতের বিজয়ের স্মারক চিহ্ন গুলো আবারও দুনিয়ার সামনে নতুন করে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদও তিনি পেতেই পারেন। তুরস্ক পলিটিকাল ইসলামকে প্রমোট করছে এটা লুকানো বিষয় নয়।মসুলমানদের আন্তর্জাতিক সংকট গুলো নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কেই সবচেয়ে সরব দেখা যায়। সেই জায়গা থেকে তুরস্ক কী সারা দুনিয়াকে মুসলিম জাহানের নেতৃত্বের জায়গায় রেখে প্রতীকী কোনো বার্তা দিচ্ছে?

আয়া সোফিয়া মসজিদে আজানের ধ্বনি হয়ত সারা দুনিয়ায় মসুলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতার বড় কোনো পরিবর্তন ঘটাবে না, তবে এর প্রতীকী বিজয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র চিন্তকদের কিছুটা হলেও ভাবনার কারণ হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ