করোনায় সংক্রমণের মাত্রার ভিন্নতা ও সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

  © টিডিসি ফটো

এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA (Ribonucleic acid) ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (নাক, গলা, ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। করোনাভাইরাসের ভিতরের অংশে RNA থাকে এবং বাহিরের আবরণে লিপিড ও স্পাইক প্রোটিন থাকে। করোনাভাইরাসের বাহিরের আবরণে স্পাইক প্রোটিনগুলো একত্রিত হয়ে মুকুটের মত ট্রাইমারস গঠন করে।

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ গবেষণা অনুযায়ী, চারটি করোনাভাইরাস, 229E, OC43, NL63 এবং HKU1, মানুষের শ্বসনতন্ত্রের উচ্চাংশে (নাক, কান, গলা) মৃদু থেকে মাঝারি সংক্রমণ করে; অন্য তিনটি করোনাভাইরাস, SARS-CoV-1, MERS-CoV ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-COV-2 (severe acute respiratory syndrome coronavirus-2) মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২ সাল থেকে চীন থেকে বিশ্বের ৩৭টি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাস SARS-CoV-1 ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোভিড-১৯ এর ভাইরাস SARS-COV-2 এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ জেনেটিক সম্পর্ক আছে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, উভয় ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল বাদুড়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই দুইটি করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে প্রথমে প্রাণীকে আক্রান্ত করে "প্রাণী মাধ্যমে" মানুষকে সংক্রমিত করেছে।

নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে আবির্ভুত হওয়ার পর এ ভাইরাস প্রধানত ফুসফুস আক্রান্ত করে রহস্যজনক নিউমোনিয়ার সৃষ্টি করার লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্স-কোভ-১ নামক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৫০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮ হাজারের অধিক মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল। বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে ও মৃতের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ প্রথমে মানুষের নাক ও গলায় এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) রিসেপটরে যুক্ত হয়ে সংক্রমণ ঘটায়। যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয়। ভাইরাস ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর বাহিরের আবরণে এক স্তরের "এপিথেলিয়াল কোষে" সমৃদ্ধ এসিই২ রিসেপটরে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে ফুসফুস আক্রমণ করে (তথ্যসূত্রঃ ৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)।

কোভিড-১৯ রোগ বিশ্বের অসংখ্য মানুষের জীবন ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট গবেষকগণেরা নিন্মোক্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজার চেষ্টা করে চলেছেন।

কেন মানুষ ব্যাপক ভিন্ন মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে?

কোভিড-১৯ রোগের অন্যতম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে মানুষ ভেদে সংক্রমণের মাত্রার ব্যাপক ভিন্নতা। কিছু আক্রান্ত মানুষের দেহে লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে না, অন্যদিকে কিছু আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে মারাত্মক বা এমনকি প্রানহানিকর নিউমোনিয়া হচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা দল কর্তৃক ইতালি ও স্পেনের প্রায় ৪ হাজার মানুষের জিনোমের (Genome) এর গবেষণা করে দেখা গেছে, মারাত্মক কোভিড-১৯ রোগের সাথে মানুষের জেনেটিক দৃঢ় সংযোগ আছে (তথ্য সূত্রঃ ৯ জুলাই ২০২০ তারিখের বিশ্বখ্যাত "ন্যাচার" জার্নাল)। জীবের বংশাণুসমগ্রকে জিনোম (Genome) বলা হয়।

যারা কোভিড-১৯ রোগের ফলে মারাত্মকভাবে ফুসফুসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাঁরা দুইটি নির্দিস্ট জিনের (Gene) ভিন্নতা বহন করে (তথ্য সূত্রঃ ৯ জুলাই ২০২০ তারিখের "ন্যাচার" জার্নাল)। কোন নির্দিস্ট Gene কোনো নির্দিষ্ট বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ভিন্ন জিন রক্তের ABO টাইপ এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্ধারন করে। নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত রকেফেলার ইউনিভার্সিটির রোগতত্ত্ববিদ জিন-লরেন্ট ক্যাস্যানোভার নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল কোভিড-১৯ রোগের সাথে জেনেটিক সম্পর্কের নতুন দিকগুলো খুঁজছেন।

আক্রান্তের দেহে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রকৃতি ও স্থায়িত্বঃ

যখন বহিরাগত আক্রমণকারী যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে, দেহের লিম্ফোসাইটস নামক ইমিউন কোষগুলো এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সাড়া দেয়। এন্টিবডি (Immunoglobulin G বা IgG) হচ্ছে প্রোটিন। এই এন্টিবডিগুলো বহিরাগত আক্রমণকারীর (এন্টিজেন) সাথে লড়াই করে এবং দেহকে অতিরিক্ত সংক্রমণের থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। বিটা- করোনাভাইরাস, HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 এর সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট নির্দিষ্ট এন্ডিবডির ফলে গঠিত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চল্লিশ সপ্তাহ টেকসই ছিল (তথ্যসূত্রঃ এপিডিমিয়োলজি এন্ড ইনফেকশন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ); অন্যদিকে, ইমারজিং ইংফেক্সাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালে সংগঠিত মহামারির জন্য দায়ী করোনাভাইরাস SARS-CoV-1 এর সংক্রমণের ফলে মানবদেহে গঠিত নির্দিষ্ট এন্ডিবডি উক্ত ভাইরাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রেখেছিল।

১৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে কোভিড-১৯ রোগ বার্ষিক (প্রতি বছর), দ্বিবার্ষিক (দুই বছরে একবার) বা বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমণ ঘটানোর সম্ভাবনা আছে। যদি এই ভাইরাসটি মানবদেহে HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 করোনাভাইরাস দুইটির মত স্বল্প সময়ের (৪০ সপ্তাহ) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে তবে প্রতি বছর কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে এবং SARS-CoV-1 করোনাভাইরাসের মত দুই বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে তবে দ্বিবার্ষিক ভাবে কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।

বেইজিং এর চায়না জাপান ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালের নিউমোনিয়া প্রিভেনশন এন্ড ট্রিটমেন্টের ডাইরেক্টর লি এর ভাষ্যমতে, যারা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তাঁদের দেহে রোগ প্রতিরোধী এন্ডিবডি উদ্দীপিত হয়েছে (সূত্রঃ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক নিউজ পেপার ইনডিপেন্ডেন্ট)। ভাইরোলোজিস্ট ড. ভিনেট মেনাচেরি প্রাক্কলন করেন, কোভিড-১৯ স্পেসিফিক এন্টিবডি দুই থেকে তিন বছর আরোগ্যলাভকারীর ব্যক্তির দৈহিক তন্ত্রে থাকবে। তবে তিনি বলেন, নিশ্চিত হতে আরোও সময় প্রয়োজন।

 

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ