নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও বাংলাদেশ

  © টিডিসি ফটো

একবিংশ শতাব্দীতে শক্তি বা জ্বালানি নিরাপত্তা যেকোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে শক্তির নিরবচ্ছিন্ন সরবারাহ আবশ্যক। উৎসের উপর নির্ভর করে মোটামুটি জীবাশ্ম শক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে ভাগে বিভক্ত করা যায় শক্তিকে। জীবাশ্ম শক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তি মধ্যে মূল পার্থক্য হল জ্বালানি বা শক্তি উৎসটির নবায়নযোগ্যতা অর্থাৎ যে জ্বালানিটি ব্যবহার করা হবে সেটি যেনো সহজে নিঃশেষ না হয়। খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি ও কয়লার মতো জ্বীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর নিঃশেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সৌরশক্তি, জলবিদুৎ ও বায়ুশক্তি এর মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের সহসা নিঃশেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে, আগামীর পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা শক্তির কোন বিকল্প নেই।

দুই,

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বিংশ শতকের ষাটের দশকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে শুরু হয়। ৯০ দশক থেকে বাংলাদেশে অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস যেমন সৌরশক্তি ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে স্বল্প পরিসরে বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্হাপনের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে নতুন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে ১৮ ই ডিসেম্বর সরকার প্রণীত "নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি" কার্যকর হয়। এ নীতির আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানির ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৯০ এর দশকের শেষ দিকে বায়োগ্যাস প্রকল্পের মাধ্যমে বসতবাড়িতে জ্বালানি গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে বায়োগ্যাস প্রকল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গ্রামবাংলায়।

তিন,

বর্তমান পৃথিবীতে সিংহভাগ শক্তির উৎসই জীবাশ্ম শক্তি। কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের মতো জীবাশ্ম শক্তির উৎসের রয়েছে সীমাবদ্ধতা। দিন দিন ব্যবহারের পর একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে জীবাশ্ম শক্তির উৎসগুলো। জীবাশ্ম শক্তির উপর নির্ভরতা কমাতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি হবে অনিশ্চিত পৃথিবী। শক্তির নির্বিচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকলে থমকে দাঁড়াবে সভ্যতার পথচলা।

পদার্থ বিজ্ঞানের মতে, "শক্তি কখন নিঃশেষ হয় না বরং শক্তি রূপ বদলায়।" জীবাশ্ম শক্তির প্রতিনিয়ত ব্যবহার পৃথিবীর জলবায়ুতে সৃষ্টি করছে বিপদজনক প্রভাব। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা। গ্রীনহাউজ গ্যাসের প্রভাবে ওজোনস্তর ক্রমশ ছিদ্র হচ্ছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রকৃতি ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য। এ পরিস্থিতিতে জীবাশ্ম শক্তি উপর নির্ভরশীলনতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

চার,

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক আকার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ফলে চাহিদা বেড়েছে শক্তির ব্যবহার। বর্তমানে বাংলাদেশের সিংহভাগ শক্তির চাহিদা জীবাশ্ম শক্তি উৎস থেকে মেটানো হলেও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত, ১০ বছরের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বেড়েছে অতীতের তুলনায় বহুগুণ।

সৌরবিদ্যুত প্যানেলের ব্যবহার এখন পৌঁছে গেছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া সহ সমগ্র বাংলাদেশে। গ্রামবাংলায় আগে যখন বিদ্যুতের সংযোগের অপ্রতুলতায় অন্ধকারছন্ন থাকতো। আজকে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলের ব্যবহারে গ্রামবাংলা আলোকিত। ২০২০ সালের বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট ( জিএসআর) এর মতে, বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত ব্যবহারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২য়। রিপোর্ট অনুসারে বর্তমানে দেশে ৮ শতাংশ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করা হয়। বাসাবাড়ি ছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন শিল্প এবং সেচ- প্রকল্পে সৌরবিদ্যুত ব্যবহার বেড়েছে।

সৌরবিদ্যুত ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও দেশের শক্তির চাহিদা মাথায় রেখে সৌরশক্তি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমানে, দেশে কোন সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র না থাকায় জাতীয় গ্রিডে সৌরবিদ্যুতের কোন অবদান নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্হাপনের উপর জোর দিচ্ছে, সেখানে আমরা এখনও কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস মাধ্যম বিদুৎ কেন্দ্র স্হাপন করছি। সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্হাপনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ক্রয়ের জন্য সরকারি ও বেসরকারি ঋণ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। মানসম্মত সৌরবিদ্যুত যন্ত্রপাতি উৎপাদন না করতে পারলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাবে দিন দিন।

পাঁচ,

বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প এখনো বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত সহ চীন, জাপান, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। সেসব দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণের বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকেই আসে এবং সে পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে রয়েছে ৭০০ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র উপকূল। উপকূল সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। বর্তমানে, সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে আমাদের। বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল ও লাভজনক। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মাথায় রেখে পাবলিক -প্রাইভেট পার্টনাশিপের মাধ্যমে উপকূলীয় জেলাগুলোতে গড়ে তোলা সম্ভব বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের।

ছয়,

বায়োগ্যাস প্রকল্পের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে জ্বালানি গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ডেইরি ও পোল্ট্রি খামার রয়েছে। বর্তমানে সবগুলো খামারকে বায়োগ্যাস প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব না হলেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ লক্ষণীয়। পাশাপাশি, ছোটখাটো গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনকারী পরিবারগুলো বায়োগ্যাস প্রকল্পের আওতায় আনা প্রয়োজন। বায়োগ্যাস প্রকল্পের মাধ্যমে পাওয়া জৈবসার, অবদান রাখতে পারে আমাদের কৃষি সেক্টরে।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ